তিউনিসিয়ায় নাম-পরিচয়হীন অভিবাসীদের কবরস্থান৷ ছবি: রয়টার্স
তিউনিসিয়ায় নাম-পরিচয়হীন অভিবাসীদের কবরস্থান৷ ছবি: রয়টার্স

ইউরোপে অভিবাসনের মধ্য দিয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখা অনেক মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হয়ে বরণ করে নেন মৃত্যু৷ কেউ হন নিখোঁজ৷ তাদের দেহাবশেষ খুঁজে পেতে প্রিয়জনদেরও সইতে হয় নানা বঞ্চনা৷ কারণ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের দেহ শনাক্ত করা দুরূহ এক কাজ৷

অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম জানিয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ২০ হাজারেরও বেশি ইউরোপমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশী ভূমধ্যসাগরে প্রাণ হারিয়েছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন৷

রাষ্ট্রীয় তথ্য নিয়ে সীমান্তে মৃত্যু বিষয়ক একটি সমীক্ষা করেছে আমস্টারডামের ফ্রাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়৷ তাতে, ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে স্পেন, ইটালি, মাল্টা এবং গ্রিসে তিন হাজার ১৮৮ অভিবাসীর মৃত্যুর তথ্য আছে, যাদের শেষকৃত্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় করা হয়েছে৷ তবে মৃত্যু ও নিখোঁজের প্রকৃত চিত্রের এটি ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র৷

মরদেহ শনাক্তে নেই কোনো ব্যবস্থা

ভূমধ্যসাগরে হারিয়ে যাওয়া কোনো অভিবাসনপ্রত্যাশীর তথ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন৷ কারণ তথ্য সংগ্রহে নিয়মতান্ত্রিক কোনো পদ্ধতি নেই বা সমুদ্রে নিখোঁজদের পরিচয়ের কোনো ডেটাও নেই৷

শুধু ইটালিতেই রয়েছে একটি ব্যবস্থা৷ রিচেরকা স্কমপার্সে হলো এমন একটি উদ্যোগ যেখানে নিখোঁজ ব্যক্তি বা অজ্ঞাত লাশের তথ্য সংরক্ষণের রূপরেখা রয়েছে৷ কিন্তু অভিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দাবি, সেটিও নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না৷

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি)-এর ট্রান্সরিজিওনাল ফরেনসিক সমন্বয়কারী হোসে পাবলো বারেবার বলেন, ‘‘এটি খুব কঠিন বিষয়৷ উদ্ধার করা মরদেহগুলো শনাক্ত করারও কোনো উপায় নেই৷ গ্রিস ও স্পেনে নিখোঁজ অভিবাসীদের ডিএনএ প্রোফাইল থাকলেও পুলিশের অনুমতি ছাড়া সেটি মিলিয়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই৷ ফলে আপনি যদি একটি মরদেহ খুঁজেও পান, সেটি শনাক্ত করবেন কীভাবে?’’

এ বছরের ২৪ জানুয়ারি লিবিয়ার গারাবুলিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে একটি নৌকা ডুবে গেলে উদ্ধার করা মরদেহগুলো ব্যাগ ভর্তি করছেন রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা৷ ছবি:পিকচার অ্যালায়েন্স/এপি/লিবিয়া রেড ক্রিসেন্ট
এ বছরের ২৪ জানুয়ারি লিবিয়ার গারাবুলিতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে একটি নৌকা ডুবে গেলে উদ্ধার করা মরদেহগুলো ব্যাগ ভর্তি করছেন রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা৷ ছবি:পিকচার অ্যালায়েন্স/এপি/লিবিয়া রেড ক্রিসেন্ট

নিখোঁজ ব্যক্তির নিবন্ধন

এতকিছুর পরেও নিখোঁজ অভিবাসীর তথ্য নথিভুক্ত করার জোর সুপারিশ জানিয়ে আসছে আইসিআরসি৷ তাদের যুক্তি হলো, আইসিআরসি, ন্যাশনাল রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির অফিস সারা বিশ্বে রয়েছে৷ ফলে পারিবারিক সূত্র খুঁজে বের করার যে কর্মসূচিটি চলমান আছে, তার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ক্যাম্প, আশ্রয়কেন্দ্র, মর্গ বা কবরস্থানের তথ্য নেয়ার সুযোগ আছে৷ সেগুলো ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে নিখোঁজ মানুষের সন্ধান পাওয়া সহজ হতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি৷

নিখোঁজ অভিবাসীদের পরিবারের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আইসিআরসি কর্মকর্তা আউরেলি দে গরস্তারজু বলেন, “নিখোঁজ পরিবারের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ৷ যদিও আমরা জানি না কখন আমরা তাদেরকে কাঙ্খিত উত্তর দিতে সক্ষম হব৷ কারণ আগ বাড়িয়ে কিছু বলা অসম্ভব৷ তবে নিখোঁজ ব্যক্তির নামটি তালিকাভুক্ত হলে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়৷’’

আইসিআরসির ‘ট্রেস দ্য ফেস’ নামের একটি ওয়েবসাইট আছে৷ এটি মূলত অনলাইন ফটো গ্যালারি৷ যেখানে হাজার হাজার লোক তাদের পরিবারের নিখোঁজ সদস্যের খোঁজ করেন৷

নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজে করণীয়

নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে তার ভ্রমণ সম্পর্কিত তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তিনি কোন পথ দিয়ে কোথায় যেতে চেয়েছিলেন—তা জানা থাকা দরকার৷ একটি টাইমলাইন তৈরি করাও জরুরি৷ নিখোঁজ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের দিন, তারিখ, সময় এবং তার ব্যবহার করা মোবাইল নম্বরটি সংগ্রহে রাখাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷

জাহাজডুবির ঘটনায় তারিখ, সময় এবং স্থান লিখে রাখতে হবে৷ নিখোঁজ ব্যক্তি যে দেশে যেতে চেয়েছিলেন, সেখানে কোনো আত্মীয় পরিজন থাকলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যতটা তথ্য পাওয়া যায় তা সংগ্রহ করতে হবে৷

ভ্রমণসঙ্গীদের সম্পর্কে তথ্য

নিখোঁজ ব্যক্তির ভ্রমণসঙ্গী এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে হবে৷ কারণ তারাই প্রথম ব্যক্তি যারা কোনো অভিবাসীর নিখোঁজ হওয়ার তথ্য দিতে পারেন৷

নিখোঁজ ব্যক্তির ভ্রমণসঙ্গীর সঙ্গে যদি যোগাযোগ হয় তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য যোগাড় করে নোট রাখা উচিত৷ এগুলোর মধ্যে আছে: তারা কোথায় ছিলেন (যেমন: দেশ, শহর, বাসস্থান), গন্তব্যে পৌঁছার পর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এমন কোনো সংস্থার নাম; তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা; নিখোঁজ ব্যক্তির সঙ্গে কী ঘটেছিল সেই তথ্য৷ 

মরদেহ শনাক্তে করণীয়

১. শনাক্তকরণ: একজন ব্যক্তির পরিচয়

২. বায়োমেট্রিক্স: ব্যক্তির জৈবিক উপাদান, যেমন: আঙ্গুলের ছাপ, চুলের গঠনের ভিত্তিতে একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়৷

৩. ডিএনএ: মানব কোষে থাকা উপাদান, যা প্রতিটি ব্যক্তির জেনেটিক তথ্য বা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। 

৪: মৃত্যুর আগের তথ্য: ব্যক্তি জীবিত থাকার সময়কার কোনো নমুনা৷ যেমন: চুল৷

৫. ময়না তদন্ত: কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পরে সংগ্রহ করা তথ্য৷ যেমন: ডিএনএ৷

শরীর ছাড়া মৃত্যুকে মেনে নেওয়া

বলা হয়, ভূমধ্যসাগরে প্রাণ হারানো মানুষের প্রায় ৭০ শতাংশ মরদেহ কখনও পাওয়া যায় না

মানবিক কারণে উদ্ধার এবং শেষকৃত্য সম্পন্ন করা মরদেহগুলোর একটি হিসাব রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়েছে আইসিআরসি৷ এজন্য একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠারও জোর সুপারিশ করেছে সংস্থাটি৷

টিএম/এফএস

 

অন্যান্য প্রতিবেদন