ইটালির দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলের কাছে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি কাঠের নৌকা৷ রোববার সকালে এই নৌকাডুবির ঘটনায় ১২ শিশুসহ ৬২ জন মারা গেছেন৷ ২০ থেকে ৩০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী এখনো নিখোঁজ বলে জানা গেছে৷
নৌকাটি তুরস্ক থেকে ইটালির দিকে রওনা হয়েছিল৷ এতে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইরানসহ আরো কয়েকটি দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ছিলেন৷ ক্যালাব্রিয়ার পূর্ব উপকূলের স্টেকাটো দি কুত্রো রিসোর্টের কাছে এসে এটি ডুবে যায়৷
এই ঘটনা ইউরোপ এবং ইটালিতে অভিবাসন নিয়ে চলমান বিতর্ককে আরো এক দফা উসকে দিয়েছে৷ সম্প্রতি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধারে কাজ করা দাতব্য প্রতিষ্ঠাগুনলোর ওপরও কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করেছে ইটালির নির্বাচিত ডানপন্থি সরকার৷
ইটালি সরকারের এমন নীতির সমালোচনা করেছে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থাগুলো৷
প্রাদেশিক সরকারের কর্মকর্তা ম্যানুয়েলা কুরা রয়টার্সকে বলেন, নৌকাডুবির ঘটনায় ৮১ জন বেঁচে আছেন৷ তাদের মধ্যে ২০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ তবে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক৷ তাকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে৷
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ইটালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেদোসি৷ তিনি জানিয়েছেন, এখনো ২০ থেকে ৩০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী নিখোঁজ৷ যাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নৌকায় দেড়শ থেকে দুইশ জন আরোহী ছিলেন৷
জাহাজটি চার দিন আগে তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলীয় বন্দর ইজমির থেকে যাত্রা করেছিল৷ ইটালীয় পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার গভীর রাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স-এর একটি বিমান জাহাজটিকে ইটালির উপকূল থেকে ৪৬ মাইল দূরে দেখতে পেয়েছিল৷
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে আসতে থাকা জাহাজটিকে আটকে দিতে একটি টহল জাহাজ পাঠানো হলেও, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সেটি বন্দরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়৷ পুলিশ জানিয়েছে, উপকূলে তখন নিরাপত্তা জোরদারে টহল টিমগুলোকে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ৷
বার্তা সংস্থা আনসা জানিয়েছে জানিয়েছে, সমুদ্র সৈকতে ভেসে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে কয়েক মাস বয়সি একটি শিশুও ছিল৷
সাত বছর বয়সী আরো এক মৃত শিশুর কথা জানিয়েছেন জরুরি চিকিৎসক দলের সদস্য লরা দে পাওলি৷ আনসাকে তিনি বলেন, ‘‘যখন আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম, দেখলাম চারদিকে মরদেহ ভাসছে৷ আমরা দুজনকে উদ্ধার করেছি, যারা একটি শিশুকে ধরে রেখেছিল৷ দুঃখের বিষয়, শিশুটি মারা গেছে৷’’

কুত্রোর মেয়র কাঁপা কাঁপা গলায় স্কাইটিজি২৪ টেলিভিশনকে বলেন, ‘‘এমন এক দৃশ্য দেখেছি, যা আপনি আপনার জীবনে কখনোই দেখতে চাইবেন না৷ এটি ভয়ঙ্কর দৃশ্য, যা আপনাকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে৷’’
এই জাহাজডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজনকে মানবপাচারের অভিযোগে আটক করা হয়েছে৷ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন গার্দিয়া দি ফিনাৎসার শুল্ক পুলিশ৷
নিরাপদ যাত্রার মিথ্যা আশ্বাস
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছেন ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি৷ জাহাজডুবির ঘটনায় মানব পাচারকারীদের দায়ী করেছেন তিনি৷ বলেছেন, ‘‘নিরাপদ যাত্রার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন তারা৷’’
মেলোনি প্রশাসন বলছে, অভিবাসীদের উদ্ধারে কাজ করা সংস্থাগুলো ইটালির দিকে বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উৎসাহিত করছে৷ তাদের এসব কর্মকাণ্ড কখনও কখনও মনে হয় তারা পাচারকারীদের অংশীদার৷
তবে সরকারের এমন ভাষ্য প্রত্যাখ্যান করেছে সংস্থাগুলো৷ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় স্পেনের অভিবাসী উদ্ধারকারী সংস্থা ওপেন আর্মস এক টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় জানিয়েছে, ‘‘এনজিওগুলোর (বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা) কাজ বন্ধ করা, অবরোধ আরোপ করা এবং বাধা দেওয়ার কারণে ভঙ্গুর মানুষগুলোর (অভিবাসনপ্রত্যাশী) মৃত্যু হবে, তারা কোনো সহযোগিতাও পাবে না৷’’
অভিবাসন সংকট মোকাবিলায় কাঠামোগত ও মানবিক দিক বিবেবচনায় নিয়ে ভূমধ্যসাগরে অনুসন্ধান এবং উদ্ধার অভিযান পুনরায় শুরু করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইতালীয় ক্যাথলিক চার্চের প্রধান কার্ডিনাল মাত্তেও জুপ্পি৷
ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করার আহ্বান রেখে টুইট করেছেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) একজন মুখপাত্র৷
রবিবার জাহাজডুবি ঘটনায় প্রাণ হারানোদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করেছেন পোপ ফ্রান্সিস৷ তিনি নিজেও আর্জেন্টিনা থেকে আসা এক অভিবাসীর সন্তান৷ অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় দীর্ঘসময় ধরেও সোচ্চার তার কণ্ঠ৷
সমুদ্রপথে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অন্যতম প্রধান ল্যান্ডিং পয়েন্ট ইটালি৷ দেশটিতে নামার পর অনেকে উত্তর ইউরোপের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে যেতে চান৷ তবে তা করতে হলে, অবশ্যই তাদের পাড়ি দিতে হয় বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিবাসন পথটি৷
জাতিসংঘের নিখোঁজ অভিবাসী প্রকল্পের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে মারা গেছেন ও নিখোঁজ হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী৷ আর চলতি বছরে এই সংখ্যাটি এর মধ্যেই ২২০ ছাড়িয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷
টিএম/আরআর (রয়টার্স)