রাষ্ট্রপতি কাইস সাইদের বক্তব্যের প্রতিবাদে ও  আফ্রিকান অভিবাসীদের সমর্থনে টিউনিশিয়ার রাজধানী টিউনিসে নাগরিকদের বিক্ষোভ। ছবি:  রয়টার্স
রাষ্ট্রপতি কাইস সাইদের বক্তব্যের প্রতিবাদে ও আফ্রিকান অভিবাসীদের সমর্থনে টিউনিশিয়ার রাজধানী টিউনিসে নাগরিকদের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

টিউনিশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরাতে সাব-সাহারা আফ্রিকার অভিবাসীদের নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ বর্ণবাদী বক্তব্য দিয়েছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷

বিগত কয়েক বছর ধরে টিউনিশিয়ায় চলছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট। যার ফলে দেশটির হাজারো নাগরিক সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসার চেষ্টা করছেন। 

কিন্তু এসব ছাপিয়ে আলোচনায় বিষয়ে পরিণত হয়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদের বক্তব্য নিয়ে৷ ২১ ফেব্রুয়ারি এক বক্তব্যে কাইস সাইদ বলেন, সাব-সাহারা আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীরা সহিংসতা, অপরাধ এবং অগ্রহণযোগ্য কাজে জড়িত। 

তার এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে এনজিও, অভিবাসন সংস্থা ও অধিকার সংগঠনগুলো। 

প্রেসিডেন্টের অভিবাসী বিরোধী বক্তব্যের পরে দেশটিতে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শারীরিক ও মৌখিক আক্রমণের ঘটনা বহুগুণ বেড়েছে বলে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে নিশ্চিত করেছে টিউনিশিয়ায় অবস্থানরত আফ্রিকান ছাত্রদের সংগঠন এইএসএটি৷

আরও পড়ুন>>সাগর পাড়ি দিয়ে ইটালিতে টিউনিশিয়ার ফুটবলার

সংগঠনটির এক কর্মকর্তা জানান, “আমাদের একজন সদস্যের বাড়িতে বুধবার ২টার দিকে বেশ কিছু টিউনিশীয় তরুণ আক্রমণ করছে। ওই ব্যক্তি আফ্রিকার দেশ মালির নাগরিক। এছাড়া অন্য একজনকে তার বাড়িওয়ালা ভবনের প্রথম তলা থেকে ছুড়ে ফেলেছেন৷’’

ফরাসি গবেষণা কাঠামো সিএনআরএস-এর টিউনিশিয়া বিশেষজ্ঞ ভানসঁ জেইসের বলেন, “মূলত টিউনিশীয় সমাজে বিদেশি অনুপ্রবেশের নিন্দা জানিয়েই কাইস সাইদ তার বক্তব্য দিয়েছেন। বক্তব্যে তিনি এনজিও ও বিরোধীদের বিদেশিদের স্বার্থে কাজ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন।”

জাতিগত বৈষম্য

এই গবেষক আরও বলেন, “আরব-ইসলামি দেশ হিসাবে টিউনিশিয়ার পরিচয়ের বিশুদ্ধতার ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রেসিডেন্ট তার ভাষণ দিয়েছেন। তবে এই ধারণার সঙ্গে আমাদেরই অবশ্যই সত্যিকারের মূল্যবোধে ফিরে যেতে হবে।”

পড়ুন>>টিউনিশিয়ায় নৌকাডুবিতে মৃত ৫, ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার ৩৭ অভিবাসী

কাইস সাইদ ২১ ফেব্রুয়ারি আরও বলেন, টিউনিশিয়ায় অবৈধ অভিবাসন একটি অপরাধী উদ্যোগের অংশ। এর লক্ষ্য টিউনিশিয়ার জনসংখ্যার গঠন পরিবর্তন করা। যাতে টিউনিশিয়া একটি আফ্রিকান দেশে পরিণত হয় এবং আরব-মুসলিম চরিত্র অস্পষ্ট হয়ে উঠে।

অভিবাসীদের কারণে জনসংখ্যায় পরিবর্তন কিংবা প্রতিস্থাপন বিষয়ক তত্ত্বটি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ হিসেবে ইউরোপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফরাসি লেখক রেনো কামু এটির সূচনা করেছিলেন। কট্টর ডান ও অভিবাসীবিরোধীরা প্রায়শই এই তত্ত্ব ব্যবহার করে থাকেন।

টিউনিশিয়ান ফোরাম ফর ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রাইটসের (এফটিডিইএস) সদস্য রমধান বেন আমোর বলেন, “এই বক্তব্যের কয়েক ঘন্টার মধ্যে টিউনিশিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচলিত গোষ্ঠী বর্ণবাদ রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদে পরিণত হয়েছে।”

সংকট থেকে দৃষ্টি ফেরানো

এই অ্যাক্টিভিস্টের মতে, “টিউনিশিয়া যে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে দায় এড়িয়ে পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিতেই কাইস সাইদ টিউনিশীয়দের জন্য একটি নতুন শত্রু তৈরি করতে চাচ্ছেন।”

আরও পড়ুন>>ইটালি থেকে দেশে ফিরল টিউনিশিয়ার সঙ্গীহীন শিশু

তিনি বলেন, ‘‘২০২১ সাল থেকে টিউনিশিয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে দুধ বা কফির মতো প্রয়োজনীয় পণ্যেরও ঘাটতি দেখা দিয়েছে৷ বিদেশিদের নিন্দা করা এই পরিস্থিতি আড়াল করারই একটি অংশ। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে দুর্বল লক্ষ্যবস্তু হিসেবে সাব-সাহারান অভিবাসীদের বেঁছে নেয়া হয়েছে।”

টিউনিশিয়ার এই অর্থনৈতিক সংকট দেশটির তরুণদের পাশাপাশি সাব-সাহারানদেরও প্রভাবিত করেছে। ভাগ্য বদলের আশায় দেশটির উপকূল থেকে ইটালির উদ্দেশে যাত্রা এক বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। 

ইউরোপীয় দেশগুলোতে অনিয়মিত অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে টিউনিশিয়া কর্তৃপক্ষ৷ অনিয়মিত অভিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রপ্রধানের দেখানো শত্রুতাও এই বিষয়ে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার একটি চেষ্টা হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে৷

যাদের লক্ষ্য করে প্রেসিডেন্ট এমন মন্তব্য করেছেন তাদের মধ্যে আফ্রিকান শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। আফ্রিকান ছাত্রদের সংগঠন এইএসএটি আপাতত ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে থাকার সুপারিশ করেছে।

সংগঠনটি অনথিভুক্ত অভিবাসীদের উপস্থিতির বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ভণ্ডামির নিন্দা জনিয়ে বলেছে, “হ্যাঁ, কিছু ছাত্র টিউনিশিয়ায় অনিয়মিত পরিস্থিতিতে আছে৷ কিন্তু এখানে রেসিডেন্স পারমিট পাওয়া খুব কঠিন।”

পড়ুন>>২০২২ সালে ১৬ হাজারের বেশি টিউনিশীয় অভিবাসী ইটালিতে

তারা জানিয়েছে, “রেসিডেন্স পারমিট পেতে আফ্রিকান ছাত্রছাত্রীদের তিনটি নথি জমা দিতে হয়। সেগুলো হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবন্ধনের একটি প্রশংসাপত্র, শিক্ষাবর্ষের অর্থপ্রদানের প্রমাণ এবং বাড়ি ভাড়া ইজারা চুক্তি৷ কিন্তু টিউনিশিয়ার বাড়িওয়ালারা প্রায়শই এই নথি দিতে অস্বীকার করে৷ কারণ, তারা ভাড়ার আয়ের ওপর কর দিতে চায় না৷ এমনকি সব নথি নিয়ে যাওয়ার পরেও আফ্রিকান হিসেবে বর্ণবাদের অসহনীয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়।”

‘সস্তা শ্রম’

গবেষক ভানসঁ জেইসের বলেন, “অভিবাসীদের শোষণ করতেই তাদেরকে অনিয়মিত রাখার বিষয়ে অনেক মালিকদের আগ্রহ রয়েছে। টিউনিশিয়ায় অনানুষ্ঠানিক খাতে অনিয়মিত অভিবাসীরা ৩০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। যাদের বেশিরভাগই সাব-সাহারা আফ্রিকা থেকে এসেছেন।” 

নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে অনেকেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আইভরি কোস্ট দূতাবাস, নিজ দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক নাগরিকদের একটি শুমারি তৈরির কাজও শুরু করেছে।

মালির দূতাবাসও দেশটির নাগরিকদের ‘স্বেচ্ছায়’ ফেরত যেতে নিবন্ধন করার প্রস্তাব দিয়েছে। ক্যামেরুনিয়ান দূতাবাসও এমন কোনো পদক্ষেপ না নিলেও, একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তেমন ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। 


এমএইউ/টিএম 




 

অন্যান্য প্রতিবেদন