ইটালির উপকূলে অভিবাসীদের নৌকাডুবির সবশেষ ঘটনাটি ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার অভিযানে নতুন করে আলো ফেলেছে, জন্ম দিয়েছে আলোচনার৷ এজন্য উদ্ধার অভিযানে বাধা দিতে ইটালির উগ্র ডানপন্থি সরকারের নেয়া নীতিকে দায়ী করছেন অনেকে৷ তবে হাল ছেড়ে না দিয়ে, নিজেদের কাজটুকু করে যেতে চায় উদ্ধারকারী সংস্থাগুলো৷
অনিয়মিত অভিবাসনের ক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগরের রুটটিকে বলা সবচেয়ে বিপজ্জনক৷ ইউরোপে এসে নিজেদের ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেকেই মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও এই পথ বেছে নেন, আবার কখনও বাধ্য হন৷ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে তারা যেসব নৌকা ব্যবহার করে সেগুলো কোনো বিচারেই সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী নয়৷
ইটালির উপকূলে গেল সপ্তাহে যে নৌকাটি ডুবে গেছে, সেখানে অন্তত ১৫০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী ছিলেন বলে জানা গেছে৷ তাদের মধ্যে ১২ শিশুসহ অন্তত ৬২ জন মারা গেছেন৷
কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে ইটালির একটি বিশেষ দায়িত্ব আছে বলে মনে করা হয়৷ কারণ, অভিবাসীরা ইটালিতে পা রেখেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন অঞ্চলে আসেন এবং আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন৷
ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ হাজার ১০৪ জন অভিবাসী ইটালিতে এসেছেন৷ আগের বছরগুলো তুলনায় এই হার অনেক বেশি বলেও জানিয়েছে তারা৷ কারণ এই সময়ের মধ্যে ২০২২ সালে এসেছিলেন পাঁচ হাজার ৩৪৫ জন এবং ২০২১ সালে এসেছিলেন চার হাজার ৩০৪ জন অভিবাসী৷ তাদের বেশিরভাগই সমুদ্রে উদ্ধারকারীদের সহযোগিতা ছাড়াই ইটালি পৌঁছেছেন৷
কী পদক্ষেপ নিলেন জর্জা মেলোনি?
ইটালির উপকূলে নৌকাডুবির পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি বলেছেন, ‘‘এমন ঘটনা এড়াতে অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করা প্রয়োজন৷’’
ডানপন্থি ফ্রাটেলি ডি’ইটালিয়ার নেতৃত্বাধীন বর্তমান জোট সরকার এ বছরের শুরুতে একটি ডিক্রি জারি করে৷ আর এর মধ্য দিয়ে সমুদ্র উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া সংস্থাগুলোর কাজ অনেকটা সীমিত হয়ে এসেছে৷
এই ডিক্রি জারির কারণে উদ্ধার অভিযানের পর কোনো সময় ক্ষেপণ না করে ইটালির একটি নির্দিষ্ট বন্দরকে বিষয়টি জানাতে হবে উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোকে৷ ফলে তারা আগের মতো করে পর পর বেশ কয়েকটি উদ্ধার অভিযানে অংশ নিতে পারবে না৷ ইচ্ছে অনুযায়ী কাছের কোনো বন্দরেও ভিড়তে পারবে না৷ যখনই কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাওয়া হয়, তখনই উদ্ধারকারী জাহাজগুলোকে বেশিরভাগ সময় ইটালির উত্তর দিকের দূরের বন্দরগুলোতে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷
উদাহরণ হিসেবে ওশ্যান ভাইকিং জাহাজটির কথা উল্লেখ করা যায়৷ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে লিবিয়ার উপকূলে জাহাজটি একটি উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়৷ উদ্ধার শেষে এটিকে রাভেনায় পাঠানো হয়৷ মানচিত্রের দিকে তাকালে বোঝা যায়, অ্যাড্রিয়াটিক বন্দরটি লিবিয়ার চেয়ে লন্ডনের কাছে৷
জারি করা ডিক্রির নির্দেশনা অমান্য করলে জরিমানা আদায়সহ শাস্তিমূলক যে ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়েছে, তা মেনে চলাও উদ্ধারকারী জাহাজগুলোর জন্য খুব কঠিন৷ কারণ মেলোনির সরকার বলছে, উদ্ধারকারী জাহাজটি যে দেশের পতাকা বহন করবে, উদ্ধারের পর অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সেই দেশেই আশ্রয় দিতে হবে৷
ভূমধ্যসাগরে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধারে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থার জাহাজগুলোতে বিভিন্ন দেশের পতাকা টানানো থাকে৷ অর্থাৎ যে জাহাজটি যে দেশের সংস্থার হয়ে কাজ করে, সেটিতে সেই দেশের পতাকা টানানো থাকে৷
জর্জা মেলোনির এই দাবির কোনো আইনি ভিত্তি নেই৷ কারণ, উদ্ধার অভিযান পরিচালিত হয় আন্তর্জাতিক জলসীমায়৷ আর যারা উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে, তারা কোনো দেশের সরকারের পক্ষ হয়ে কাজটি করছে না৷
কিভাবে কাজ করছে উদ্ধারকারীরা?
ডিক্রিটি জারির পরপরই ১৮টি সমুদ্র উদ্ধারকারী সংস্থা এবং সমমনা কয়েকটি সংগঠন একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে৷ বিবৃতিতে সমুদ্রে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের সহায়তায় বাধা দিতে ইটালি সরকারের এমন পদক্ষেপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়৷

এতে আরো বলা হয়, ‘‘ডিক্রিটি আন্তর্জাতিক জলসীমা, মানবাধিকার এবং ইউরোপীয় আইন লঙ্ঘন করেছে৷ এজন্য ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় সংসদ এবং ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত৷’’
স্প্যানিশ সংস্থা প্রোঅ্যাক্টিভা ওপেন আর্মসের ইটালি শাখার সভাপতি ভেরোনিকা আলফনসি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উদ্ধারকারী জাহাজগুলোর চলাচলে যদি বাধা দেওয়া হয়, জরিমানা করা হয়, অপ্রয়োজনীয় পথে যেতে বাধ্য করা হয় এবং তা যদি অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে বেশিদিন কাজ চালিয়ে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব হবে না৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘তবে এটাও সত্য, সাত বছর ধরে অসাংবিধানিক আইন এবং ইউরোপীয় নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে আমরা একাই লড়াই করে যাচ্ছি, তবুও আমাদের কাজ থেমে নেই৷’’
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) পরিচালিত জিও ব্যারেন্টস জাহাজটির কাজ আপাতত বন্ধ৷ কারণ, ইটালির সরকারের জারি করা নতুন ডিক্রিটি লংঘনের অভিযোগে গত সপ্তাহে জাহাজটিকে ২০ দিনের জন্য সিসিলিতে আটক করা হয়েছে৷ ১০ হাজার ইউরো জরিমানাও চাওয়া হয়েছে৷ ইটালি সরকারের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আইনের আশ্রয় নিতে যাচ্ছে এমএসএফ৷ সংস্থাটির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন হয়েছে৷
উপকূলরক্ষীদের বিরুদ্ধে তদন্ত দাবি
ইটালির উপকূলে সাম্প্রতিক নৌকাডুবি নিয়ে জানতে চাইলে ওপেন আর্মসের ভেরোনিকা আলফনসি বলেন, ‘‘এটি কোনো ট্র্যাজেডি নয়, এটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল৷’’
দুর্ঘটনার দিন কোস্ট গার্ডের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে তদন্ত দাবি করেছেন এই অধিকারকর্মী৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা বুঝতে পারছি, ফ্রন্টেক্স সতর্কতা সংকেত দিয়েছিল৷ দুটি কোস্ট গার্ড টহল বোটকে নৌকাটি খুঁজতে পাঠানো হয়েছিল৷ খারাপ আবহাওয়ার কারণে তারা ফিরে আসে৷ পুরো বিষয়টি যাচাই করা উচিত৷ কারণ খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে একটি নৌকাকে আপনি ফেলে আসতে পারেন না৷ কোনো অবস্থাতেই তা পারেন না৷’’
ডুবে যাওয়া নৌকাটি তুরস্কের ইজমির থেকে যাত্রা করেছিল৷ ইজমির হয়ে ইটালিতে আসার রুটটি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ এখনও অতোটা অবগত হতে পারেননি বলে মনে করেন ভেরোনিকা আলফনসি৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সম্প্রতি আফগানিস্তান এবং ইরানের শত শত মানুষ এই রুটটি দিয়ে ইউরোপে আসার চেষ্টা করছেন৷ কারণ, এটিকে নিরাপদ মনে করছেন তারা৷ কিন্তু তারা নিরাপদ মনে করলেও সেটা ঠিক নয়৷’’
টিএম/এফএস