ভয়াবহ ভূমিকম্প ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে তুরস্ক ছেড়ে নিজ দেশ সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ফিরে গেছেন প্রায় ৪০ হাজার সিরীয় শরণার্থী।
সিরিয়ার বাব আল-হাওয়ার সীমান্তে কর্মরত মিডিয়া অফিসার মাজেন অ্যালুশ রয়টার্সকে একটি হিসাব দিয়েছেন। সেই হিসাব অনুযায়ী, ১৩ হাজার ৫০০ শরণার্থী নিজ দেশ সিরিয়ায় ঢুকেছে বাব আল-হাওয়া সীমান্ত দিয়ে। জারাবুলুস সীমান্ত দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে ফিরে এসেছেন প্রায় ১০ হাজার সিরীয়। আর বাব আল-সালাম এবং তেল আবিয়াদ দিয়ে ঢুকেছে অন্তত আরও ৭ হাজার মানুষ।
তবে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ৪০ হাজার সিরীয় শরণার্থী নিজ দেশে ফিরে গেছেন। আরও অনেকে নিজ দেশে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
যুদ্ধ পালিয়ে আসা সিরীয় নাগরিকদের আশ্রয় দেয় তুরস্ক। অন্তত ৩৬ লাখ সিরীয়কে আশ্রয় দিয়েছে দেশটি। যা তুরস্ককে বিশ্বে সর্বোচ্চ শরণার্থীর দেশে পরিণত করেছে। ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের জের ধরে আসা এই মানুষগুলো তুরস্কে নিজেদের অনেকটা খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক জুড়েও বাড়তে থাকে শরণার্থী বিরোধী মনোভাব। কারণ দেশটির সাধারণ মানুষ মনে করেন, সিরীয়দের জন্য তাদের চাকরি পেতে সমস্যা হচ্ছে এবং এমনকি দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে।
এসব মিলিয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরে সবদিক বিবেচনায় নিয়ে প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেক সিরীয় নাগরিক।
তুরস্ক যেন শরণার্থীদের রাজধানী
২০২২ সালের এপ্রিলে আশ্রিত সিরীয়দের অবাধ চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তুরস্ক। সরকারের যুক্তি ছিল, সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে যদি পরিস্থিতির উত্তরণ হয় এবং সেখানে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে তুরস্কের অস্থায়ী সুরক্ষা নেয়া সিরীয়দের নিজ দেশে ফেরত যাওয়া উচিত।
তুরস্কে সিরিয়ার শরণার্থীদের সংখ্যা কমানোর একাধিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। কারণ এতে অনেক সিরীয় নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইবেন বলে ধারণা তুর্কি সরকারের। তবে ভূমিকম্পে দুই দেশের ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় সীমান্ত নিরাপত্তা অনেকটা শিথিল করে দেয় তুরস্ক।

আবারও সবহারা সিরীয় শরণার্থীরা
সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ছয় মাস কাটিয়ে এলে আবারও তুরস্ক ফেরা যাবে—এমন নিশ্চয়তা পাওয়ার পর অন্তত ৪০ হাজার মানুষ তা লুফে নিয়েছেন। আবার অনেকেই গেছেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত নিকট আত্মীয়দের খোঁজখবর নিতে।
ভূমিকম্পের কারণে তুরস্কে আশ্রিত সিরীয়দের বাড়ি-ঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ায়, তাদের কেউ কেউ নিজ দেশে ফিরেছেন আত্মীয়দের কাছে আশ্রয় নিতে। গৃহযুদ্ধের কারণে সব হারিয়ে এই মানুষগুলোর আশ্রয় হয়েছিল তুরস্কে। সেখানেও গত কয়েক বছরে কোনোরকম জীবন কাটিয়ে যেটুকু সঞ্চয় হয়েছিল, সেটিও কেড়ে নিল এই ভূমিকম্প। সিরীয় শরণার্থীদের অনেকে এখন তাদের নিজ দেশে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ফিরে যাবেন বলে আশা করছে তুরস্ক সরকার।
এদিকে, ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায় সরকারের প্রতি জনগণের যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান। ফলে এই সময় শরণার্থীদের বোঝা যত হালকা হয়, তুরস্কের জন্য সেটা তত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
‘শুধু ফিরে যেতে চাই’
ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের একটি কাহরামনমারাসে থাকতেন সিরীয় শ্রমিক খালেদ আল-আহমেদ। গত ৮ বছর ধরে তুরস্কে আছেন তিনি। এখন নিজ দেশ সিরিয়াতে ফিরে যেতে চান। কারণ ৫০ বছর বয়সি এই শ্রমিক যে ঘরে থাকতেন, সেখানে ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছু নেই।
তিনি বলেন, “মানুষ আসলে কোথায় যাচ্ছেন, কী করবেন, কেউ কিচ্ছু জানেন না। কিন্তু সবাই এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছেন।”
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় ব্যর্থ জাতিসংঘ
ভূমিকম্পে সব হারিয়ে নিজ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ফিরতে শুরু করেছেন সিরীয় শরণার্থীরা। কিন্তু সেখানে তারা কতোটা ভালো থাকবেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। জাতিসংঘ বলছে, সবশেষ দুর্যোগের আগেও ওই অঞ্চলে বসবাসরত ৪০ লাখ মানুষের বেশিরভাগই মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
গৃহযুদ্ধের কারণে এই অঞ্চলটিকে দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল সরকার। শুধু তুরস্কের সঙ্গে একটি সীমান্ত সচল ছিল, সেটি দিয়েই সেখানে সাহায্য পাঠানো হতো। এমনকি জাতিসংঘের ত্রাণ প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস ১২ ফেব্রুয়ারি স্বীকার করেছেন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সিরিয়ার মানুষের জন্য কিছু করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
টিএম/এআই