ইল-দ্য-ফ্রন্সঁ অঞ্চলের মেনিল-আমোলে ডিটেনশন সেন্টার বা সিআরএ এর সামনে অভিবাসন সংস্থা লা সিমাদের বিক্ষোভ। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস
ইল-দ্য-ফ্রন্সঁ অঞ্চলের মেনিল-আমোলে ডিটেনশন সেন্টার বা সিআরএ এর সামনে অভিবাসন সংস্থা লা সিমাদের বিক্ষোভ। ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস

চলতি মাসের শুরুর দিকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের অদূরে অবস্থিত মেনিল-আমোলে ডিটেনশন সেন্টার থেকে নিজেদের কার্যক্রম প্রত্যাহার করেছে অভিবাসন সংস্থা লা সিমাদ৷ সংস্থাটির এই সিদ্ধান্তের পর থেকে আটককেন্দ্রটিতে ‘অশান্ত’ পরিস্থিতি বিরাজ করেছে৷

ফ্রান্সের বৃহৎ অভিবাসন সংস্থা লা সিমাদ ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঘোষণা দেয় তারা আর ইল-দ্য-ফ্রন্সঁ অঞ্চলের মেনিল-আমোলে ডিটেনশন সেন্টার বা সিআরএ-তে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে না৷ 

সংস্থাটির অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে তারা সরকারের কাছে আটক কেন্দ্রের পরিস্থিতি এবং অন্যায় ও বেআইনি ‘ডিপোর্ট’ নিয়ে নিয়মিত উদ্বেগ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে৷ কিন্তু সরকার অধিকার ও অভিবাসন সংস্থাগুলোর দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছে না৷ 

লা সিমাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে সেখানে অবস্থানরত অভিবাসীরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে৷ কারণ আটক থাকা অভিবাসীদের সমস্যা ও আইনি বিভিন্ন জটিলতা দূর করতে সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে সহায়তা করে আসছিল৷ 

আরও পড়ুন>>ফ্রান্সে বিদেশিদের ‘পেনশন’ অধিকার

উল্লেখ্য, মেনিল-আমোলে নামক সিআরএটি ফ্রান্সের বৃহত্তম আটককেন্দ্র৷ এটি প্যারিসের রোয়াসি বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে কয়েকশ মিটার দূরে অবস্থিত৷

সংসদ সদস্যের পরিদর্শন

লা সিমাদ তাদের কার্যক্রম প্রত্যাহারের পর ২ ফেব্রূয়ারি, বৃহস্পতিবার, ফরাসি বিরোধী দল লা ফ্রন্সঁ আনসুমিজের এক সংসদ সদস্য কেন্দ্রের পরিস্থিতি পরিদর্শনে আসেন৷ 

সংসদ সদস্যের সফরকে ঘিরে আটককেন্দ্রটির সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করে অভিবাসন সংস্থা লা সিমাদ৷ 

সংসদ সদস্যদের পরিদর্শনকালে, আটক কেন্দ্রে বন্দি অভিবাসীরা তাদের অধিকার ও অসুবিধা সম্পর্কে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল৷

পড়ুন>>ফ্যাক্টচেক: ফ্রান্সে ৪০ শতাংশ বিদেশি কি নিষ্ক্রিয়?

কেন্দ্রটির মূল দরজা পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই অভিবাসীদের সামনে পড়েন সংসদ সদস্য এরসিলা সুদেই৷ তিনি সেখানে প্রবেশের সাথে সাথেই আফ্রিকা অভিবাসী জনাথন বলেন, ‘‘আপনি যদি আমাকে এখান থেকে বের করেন তাহলে আমি আপনাকে ভোট দেব৷ ফ্রান্সে আমার সন্তানরা রয়েছে৷ আমাকে আফ্রিকাতে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে!’’

আফ্রিকাতে ডিপোর্টের উদ্দেশ্যে এক মাস ধরে এই কেন্দ্রে আটক আছেন জনাথন৷ তিনি চাচ্ছিলেন সংসদ সদস্যের কাছে সব খুলে বলতে৷ 

জনাথনের কক্ষের ঠিক পিছনে যেই কক্ষটি রয়েছে সেখানে নিয়মিত শরণার্থী ও রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত ফরাসি দপ্তর অফপ্রার সাথে অভিবাসীদের ভিডিও সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়৷ 

আরও পড়ুন>>ফ্রান্স: ধর্মঘটের অধিকার ও নিয়মসমূহ

করিডোরের আরও খানিকটা এগোলে ফরাসি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন বিষয়ক দপ্তর (অফি) এর কার্যালয়৷ এটির ঠিক পাশেই লা সিমাদের জন্য নির্ধারিত কার্যালয়ের কক্ষটি অবস্থিত৷ যেটি চলতি মাসের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে৷

ফ্রান্সের বৃহত্তম এই সিআরএ থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও এখনও সেখানে সংস্থাটির কিছু পোস্টার সেখানে ঝুলানো আছে৷ 

আটককেন্দ্র বিষয়ক সিমাদের জাতীয় পরিচালক দালিয়া ফ্রন্টজ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই কেন্দ্রে উত্তেজনা বিরাজ করছে৷ পুরো কেন্দ্রটিতে একটি চরম অব্যবস্থাপনা ও নাজুক পরিস্থিতি চলছে৷’’

১১টি ‘ডিপোর্ট’

এক মাসে ১১ জন অনিয়মিত অভিবাসীকে এই কেন্দ্র থেকে তাদের নিজ দেশে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো বা বহিষ্কার করা হয়েছে৷ 

এই লোকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রশাসনিক আদালতে আপিল করেছিলেন৷ উদাহরণস্বরূপ, মি. বি নামের একজনকে বহিষ্কার করা হয়েছিল৷ তিনি বিবাহিত এবং ফ্রান্সে তার সন্তান ছিল৷ প্রশাসনিক আদালতে বহিষ্কারের বিরুদ্ধে তার আপিল আবেদন চলমান ছিল৷

পড়ুন>>ফ্রান্স: আল্পস-মারিতিমে রেকর্ডসংখ্যক অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসী

অভিবাসন সংস্থা ও এনজিওগুলোকে এসব বহিষ্কারকে বেআইনি ও অবৈধ ডিপোর্ট আখ্যা দিয়েছে৷ ফ্রান্সের বিভিন্ন আটককেন্দ্রে সক্রিয় অভিবাসন সংস্থাগুলো সম্প্রতি শীর্ষ ফরাসি সংবাদ মাধ্যম লো মোন্দে একটি যৌথ বিবৃতি ও ট্রিবিউন প্রকাশ করেছে৷ 

বিবৃতিতে সংস্থাগুলো দাবি করেছে, রাষ্ট্র বেইআইনিভাবে এসব অবৈধ অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছে৷ এ জাতীয় ‘ডিপোর্ট’ কার্যক্রম জোরদার করা আমাদের কার্যক্রমের বিরোধী৷ সিআরএতে আটক থাকা একজন অনিয়মিত অভিবাসীকে যখন ডিপোর্ট করা হয়, তখন তিনি প্রতারিত হয়েছেন বলে মনে করেন৷ এভাবে চলতে পারে না! 

দালিয়া ফ্রন্টজ আরও জানান, ‘‘কেউ অবৈধ বহিষ্কারের শিকার হলে তখন তারা আমাদের বলেন, আপনারা আমাদের যা ব্যাখ্যা করেছিলেন সব মিথ্যা! এটি সিআরএর মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে

আরও পড়ুন>>প্যারিসের কাছে আটক কেন্দ্র থেকে তিন অভিবাসনপ্রত্যাশী পলাতক

লা সিমাদের সভাপতি অনরি মাসো বলেন, ‘‘এসব ঘটনায় আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রভাবিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়৷’’

লা সিমাদ মেনিল আমোলে কেন্দ্র ত্যাগের পর সংস্থাটির সাথে বৈঠক করেছেন বিদেশীদের জন্য নির্ধারিত ফরাসি অধিদপ্তরের ডিরক্টরেট জেনারেল এবং ফরাসি সীমান্ত পুলিশ (পিএএফ)৷ 

বেশ কয়েকটি বিষয়কে সামনে রেখে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ 

‘আমি জানি না, আমি কখন বের হবো’

লা সিমাদের এক মাসের অনুপস্থিতি এরই মধ্যে অনুভব করতে শুরু করেছেন অভিবাসীরা৷ 

জনাথন ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘যদি সিমাদ থাকত তবে প্রশাসনিক আদালতের মাধ্যমে আমি এখান থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেতাম৷’’ 

আপাতত তিনি জানেন না কোনও ফ্লাইটে তাকে তার নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে কি না৷ 

নিজের কথা শেষ করে পেছন থেকে গণমাধ্যম ও অন্যান্য উপস্থিতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ভুলে যাবেন না!’’

এই কেন্দ্রের আরেক বন্দি অভিবাসী আবেদল ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘আমি এখানে আসার পর থেকে ১৫ কেজি ওজন হারিয়েছি৷’’এ

এই দীর্ঘদেহী অভিবাসী তার বক্তব্য প্রমাণে আমাদের সামনে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে প্রবেশ করে তার আগের ছবি দেখাতে শুরু করেন৷ আবদেল এখানে ৭৫ দিন ধরে আটক আছেন৷ 

আরও পড়ুন>>যুক্তরাজ্য: আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের কুখ্যাত নেতা আটক

ফরাসি সিআরএগুলিতে আটক রাখার শর্তগুলি নিয়ে নিয়মিতভাবে অভিবাসীরা এবং অধিকার সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে নিন্দা জানিয়ে আসছে৷ 

উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের জানুয়ারির শুরুতে মেনিল-আমোলেতে আটক থাকা তিনজন অভিবাসনপ্রত্যাশী এই কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল৷ তাদের অভিযোগ ছিল তাদেরকে নগ্ন করে অনুসন্ধান করা হয়েছে যেটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ৷

এছাড়া বিভিন্ন সময় আটককেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন দাবিতে অনশন এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টার মত ঘটনাও উঠে আসে৷


এমএইউ/আরআর





 

অন্যান্য প্রতিবেদন