উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপের দেশ ইটালিতে আসতে চেয়েছিলেন ২৮ বছর বয়সি আর্নাউড ইয়াও৷ কিন্তু তিনি জানতেন না ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার আগে তার জন্য অপেক্ষা করছিল নির্মম ও দুঃসহ জীবন৷ এখন ফ্রাঙ্কো-ইটালীয় সীমান্তের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে সমাজকর্মী ও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখছেন তিনি৷ ইনফোমাইগ্রেন্টসের বিশেষ প্রতিবেদন।
লিবিয়ায় অনেকটা দাসত্বের জীবন কাটাতে হয়েছে আইভরি কোস্টের এই তরুণকে৷ তবে পিছু হটেননি আর্নাউড ইয়াও৷
চলতি বছরের জানুয়ারির কথা৷ নিজের ২৮তম জন্মদিনের স্থায়ী চুক্তির প্রস্তাব পেয়েছেন অভিবাসী আর্নাউড ইয়াও। কিন্তু অন্য দশটা চাকরির মতো সাধারণ কাজ ছিল না সেটি৷ এটি হলো, আশ্রয়শিবিরে সমাজকর্মী হিসেবে আশ্রয়প্রার্থীদের সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন তিনি৷
ফ্রাঙ্কো-ইটালীয় সীমান্তের সুসা উপত্যকার অভিবাসন সংস্থা ফ্রেটারনিটা ম্যাসির সঙ্গে কাজ করবেন আর্নাউড ইয়াও। প্রতি বছর কয়েক হাজার আশ্রয়প্রার্থী ও অভিবাসনপ্রত্যাশী ভিড় করেন এই কেন্দ্রে।
আরও পড়ুন>>ইটালিতে নৌকাডুবি: স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছেন নিহতের স্বজনরা
২০২১ সালে এই কেন্দ্রটিতে একজন শরণার্থী হিসেবে এসেছিলেন আর্নাউড। চওড়া কাঁধ, ঘন দাড়ি এবং বাহুতে উল্কি আঁকা এই যুবকের অতীত অভিজ্ঞতা অত্যন্ত করুণ ও মর্মান্তিক। মূলত ২০১৬ সালে ইটালিতে আসেন তিনি।
এখানে আসার পর থেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে প্রতি মাসে অভিবাসীদের প্রবাহ বদলে যেতে দেখেছেন আর্নাউড।
ইনফোমাইগ্রেন্টসকে তিনি বলেন, “গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের আগমন কমেছে। তবে এর পেছনের কারণ আমরা জানি না। বর্তমানে, গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন আশ্রয়প্রার্থী আসছেন। বিশেষ করে সাব-সাহারা আফ্রিকা এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে আগতদের সংখ্যা বেশি। আগের তুলনায় আফগানদের সংখ্যা অনেক কম।”
পড়ুন>>সন্তানের চিকিৎসার আশায় দেশ ছাড়েন পাক ক্রীড়াবিদ শাহিদা
২০১৭ সালে ‘ফ্রেটারনিটা ম্যাসি’ নামের এই কেন্দ্রটির প্রতিষ্ঠা করেন বুসোলেনোর ধর্মযাজক ডন লুইগি চিয়াম্পো। পশ্চিম বা উত্তর ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করা অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য এটি একটি স্টপওভার বা ট্রানজিট জোন হিসাবে কাজ করে৷
২০২২ সালে ১৫ হাজার অভিবাসী এই কেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন দেশে গেছে। ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বার্ষিক ভর্তুকির একটি অংশ আসে এখানে৷
মধ্যস্থতাকারী এবং বহুভাষী
আশ্রয়কেন্দ্রের ডজনখানেক কর্মচারীর মধ্যে দুজন আলবেনীয় এবং একজন মালির নাগরিক৷ মাতৃভাষা বাউলের পাশাপাশি ইংরেজি, ইটালিয়ান এবং ফরাসি ভাষায় দক্ষতা থাকায় চাকরিটি পেয়েছেন আর্নাউড ইয়াও৷
তিনি বলেন, “আমাকে যখন আশ্রয়ের কথা বলা হয়েছিল তখন আমি নিজেকে বলি আমি ফরাসি ভাষায় কথা বলি এবং কৃষ্ণ বর্ণের। এই কেন্দ্রে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে পারব।”
কিন্তু ভাষার বাইরেও, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তার গুণাবলীর কারণে মূলত অভিবাসন সংস্থা তাকে নিয়োগ দিয়েছে৷
আরও পড়ুন>>তুরস্ক-ইটালি রুটে দ্বিগুণ হয়েছে অভিবাসীপ্রত্যাশী
২০১৬ সালে ইটালিতে আসা এই তরুণ আইভোরিয়ান দ্রুত ইটালীয় ভাষা শিখেছিলেন। পাশাপাশি আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত কমিউনিটি হাউস এবং কেন্দ্রগুলিতে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করা শুরু করেছিলেন।যেখানে তার অভিবাসনের অভিজ্ঞতা ইটালীয় প্রশাসনের জন্য দরকারি বলে প্রমাণিত হয়।
আর্নাউড বলেন, “অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা মনে করেন, তারা ফ্রান্সে না থাকা মানে তারা ইউরোপে নেই। আমি তাদের বুঝিয়ে দিই যে ইউরোপ একটি ধৈর্যের প্রশ্ন। যেটির মাধ্যমে ইটালীয় নাগরিক হওয়া পর্যন্ত আগানো যায়। এখানে ভবিষ্যত আছে। অনেকবার আমি লোকজনকে থাকতে রাজি করিয়েছি। কিন্তু মাঝে মাঝে তাদের ফ্রান্সে যাওয়া থেকে আটকাতে পারি না আমরা।”
ছোট ঘরে ৫৪ জন
শৈশবে আর্নাউড ইয়াও কখনোই তার দেশ ছেড়ে ইউরোপে যাওয়ার কথা ভাবেননি। ২০১১ সালে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি লরেন্ট গ্বাগবো এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী আলাসানে ওউত্তারার সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ সহিংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আইভোরি কোস্টের রাজধানী থেকে পালাতে বাধ্য হন তিনি। সেই সময় গৃহযুদ্ধে কয়েক শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়৷
ঘানা এবং নাইজারে বেশ কয়েক বছর ঘুরে বেড়ান তিনি। এই দুই দেশে পেশাদার ফুটবল দলে যোগ দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন।
আরও পড়ুন>>গ্রিসের কড়া নীতি নৌকাডুবিতে ভূমিকা রাখতে পারে: ইটালির মন্ত্রী
একদিন এক খবর শুনে মন খারাপ হয় আর্নাউডের৷ তার বন্ধু তাকে জানায়, তার বন্ধুকে লিবিয়ায় তার নিয়োগকর্তা বন্দি করে রেখেছেন এবং মুক্তি পেতে মুক্তিপণ দাবি করছেন।
এই সংবাদ পেয়ে আর্নাউড তার সব সঞ্চয় সংগ্রহ নিয়ে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোয়নি৷ তিনি বলেন, “আমি সীমান্তে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার কাগজপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমার কাগজপত্র চুরি হয়ে গেলে আমাকে কারারুদ্ধ করা হয়।”
লিবিয়ার জাউইয়াতে পৌঁছার আগে তাকে বেশ কয়েক মাস ধরে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছিল। যেখানে দুই হাজারেরও বেশি বন্দিকে আটকে রাখা হয়েছিল।
যাদের বেশিরভাগই সাব-সাহারা আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসী। দাসত্ব ও মুক্তিপণ আদায়ের জন্য এসব অভিবাসীদের বিভিন্ন আটক কেন্দ্রে ও কারাগারে আটকে রাখা হতো।
পড়ুন>>বৈধতার দীর্ঘসূত্রতায় ইটালির অনিয়মিত বাংলাদেশিরা
আর্নাউড ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “১৫ বর্গমিটারের একটি ঘরে ৫৪ জন একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের পা মেলে বসার জায়গাও ছিল না। আমি প্রতিদিন লিবীয়দের হাতে মার খেয়েছিলাম।”
মুরগির খাঁচা পরিষ্কার করার জন্য অন্য পাঁচজন অভিবাসীসহ একজন ব্যবসায়ী তাকে দাস হিসেবে কিনেছিলেন।
তিনি বলেন, “আমি একটু আরবি এবং ইংরেজি বুঝতে পারতাম৷ আর তাই পাঁচজনের দলের মুখপাত্র হয়েছিলাম আমি। প্রথমে একটি মুসলিম নাম বলেছিলাম, তাই তারা আমাকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম শেষ পর্যন্ত আমার ঠিকানা হবে কারাগার।”
সমুদ্রে ৭২ ঘন্টার যাত্রা
২০১৬ সালের এক শুক্রবার আর্নাউড ইয়াও তার রক্ষীদের হাত থেকে বাঁচতে জুমার নামাজের সুযোগ নিয়েছিলেন৷ নামাজের সময় তিনি সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ ঘোরাঘুরির পর পশ্চিম লিবিয়ার উপকূলীয় শহর জোয়ারাতে পৌঁছেছিলেন। ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করা অনেক নৌকার সূচনা পয়েন্ট এই উপকূল।
এই উপকূল থেকে আর্নাউড তার ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রথমবার, তিনি একটি পুরানো নৌকায় ১২৪ জন যাত্রী নিয়ে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিবিয়ার কোস্টগার্ড নৌকাটিকে আটকে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন>>বলকান হয়ে ইউরোপ: ৬ দেশে সোয়া ৩ লাখ অভিবাসনপ্রত্যাশী
দ্বিতীয়বার, আরেকটি নৌকায় আন্তর্জাতিক জলসীমায় পৌঁছালেও শেষ পর্যন্ত নৌকার ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, “আমার তখন সমুদ্রে প্রার্থনা করতে থাকি এবং আমার মায়ের কাছে অন্তর থেকে ক্ষমা চাইছিলাম। সমুদ্র অনেক ঢেউ ছিল, জলে ঘূর্ণি ছিল এবং আমি সাঁতার জানতাম না। আমাদের কাছে লাইফ জ্যাকেট ছিল না, কিছুই ছিল না।”
তিন দিন সমুদ্রের মাঝখানে ভেসে থাকার পর অবশেষে ইটালীয় নৌবাহিনী নৌকাটিকে উদ্ধার করে।
তিনি যোগ করেন, “এটি আমার জীবনের একটি অন্ধকার অধ্যায় যা আমি কখনই ভুলতে পারব না। ভুমধ্যসাগর একটি উন্মুক্ত সলিল সমাধি। যেদিন আমাদের ধরা হয়েছিল, সেখানে আটটি নৌকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।”
অভিবাসীদের ‘ইন্টিগ্রেশন’ সহজতর করা
দিনটি ছিল ২০১৬ সালের ২৫ মে৷ অবশেষে সিসিলির পালেরমোতে পৌঁছান আর্নাউড ইয়াও৷ আশ্রয় আবেদন দাখিলের পর তিনি ইটালিতে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দেন এবং তুরিনে লজিস্টিক ম্যানেজমেন্টের ওপর একটি কোর্স করেন।
একই সময়ে, তিনি অন্যান্য আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তার মিশন শুরু করেছিলেন, যা আজকে স্থায়ী চাকরির চুক্তি পেয়ে পূর্ণতা লাভ করেছে।
আরও পড়ুন>>স্বচ্ছলতা ফেরাতে কেদার দুই বছরের যাত্রা
২০২১ সালে ফ্রেটারনিটা ম্যাসিতে আগমনের পরেও এই যুবক ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগ রেখেছন৷ এমনকি ইটালীয় পঞ্চম ডিভিশনে (ফ্রান্সের তৃতীয় ডিভিশনের সমতুল্য) মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলছেন তিনি।
এই ক্যাথলিক জানান, “আমি সবসময় একজন ফুটবলার হিসাবে জীবনের স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু ভাগ্য আমার জন্য অন্য কিছু রেখেছেন।”
তার আশা, একদিন তরুণ অভিবাসীদের জন্য একটি ফুটবল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে স্থাপন করবেন।
মূল প্রতিবেদন লুইস শাহোনিও। ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলায় ফরাসি থেকে ভাষান্তর মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ।
এমএইউ/টিএম