ইটালির ক্যালাব্রিয়া উপকূলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মর্মান্তিক নৌকাডুবির ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে আরো একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এই ঘটনায় মোট চার জনকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। ওই নৌকাডুবিতে মারা গেছেন বিভিন্ন দেশের অন্তত ৭২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী।
ইটালির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনিয়মিত পথে সমুদ্র পারাপারে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২৭ বছর বয়সি এক তুর্কি নাগরিককে অস্ট্রিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ নৌকাডুবির দিন ঘটনাস্থল থেকে এই তরুণ কৌশলে পালিয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে।
এই তুর্কি নাগরিককে গ্রেপ্তারে ইউরোপীয় পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর তাকে পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছে। অস্ট্রিয়া পুলিশের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ওই তরুণকে অস্ট্রিয়া থেকে ইটালিতে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নৌকাডুবির ঘটনায় এর আগে দুইজন পাকিস্তানি ও একজন তুর্কিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে, দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা তাদের শনাক্ত করেছেন।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের ইজমির থেকে গাদাগাদি করে নৌকাটি আনুমানিক ১৮০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নিয়ে ইটালির উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইটালির উপকূলের কাছে এসে পাথরে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় নৌকাটি।
আরো পড়ুন: ইটালি: নৌকাডুবি থেকে বেঁচে ফেরাদের পাশে ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেন
এখন পর্যন্ত ৭২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৮ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং ৩০ জন নারী রয়েছেন। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৩০ জন।
চলছে তদন্ত
দুর্ঘটনা কারণ অনুসন্ধানে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রোম কর্তৃপক্ষ। একটি তদন্ত দল ওই ঘটনায় মানবপাচারকারীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। অপর দলটির কাজ হলো, এমন ঘটনা যাতে নিজেদের জলসীমায় না ঘটে সে জন্য কী পদক্ষেপ নিতে পারে ইটালি, তা যাচাই করে দেখা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহিঃসীমান্ত সংস্থা (ফ্রন্টেক্স) তাদের একটি টহল বিমান থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে আসা নৌকাটির বিষয়য়ে ইটালির উপকূলরক্ষীদের জানিয়েছিল।
কিন্তু তারা খারাপ আবহাওয়ার কারণে উদ্ধার অভিযানে যেতে পারেনি। সমালোচকরা বলছেন, ইটালি ইচ্ছা করেই উদ্ধার অভিযান দেরি করেছে। ফলে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। কিন্তু অভিযোগটি মানতে নারাজ ইটালি।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি বলেছেন, সমুদ্রে নৌকাটি দেখার পর, সেটির চলাচলে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা, তা নিয়ে উপকূলরক্ষীদের কিছু জানায়নি ফ্রন্টেক্স। এমনকি উপকূলে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল বলেও দাবি করেন তিনি। তবে এসব যুক্তি মানতে নারাজ মেলোনির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বিরোধী নেতারা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি। সেখানেই মন্ত্রিসভা নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক করেন তিনি। চোরাকারবারি এবং পাচারকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান রেখে একটি বিলে সই করেন মেলোনি।
স্বজনহারা মানুষের ক্ষোভ
নৌকাডুবির শিকার হওয়া বেশিরভাগ মানুষ এসেছে আফগানিস্তান থেকে। আর কয়েকজন ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক। ওই দুর্ঘটনায় নিহতদের ইউরোপীয় স্বজনরা ইটালির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ক্রোটোনে জড়ো হয়েছেন। কারণ, সেখানে রাখা হয়েছে সব মরদেহ।
আরো পড়ুন: সন্তানের চিকিৎসার আশায় দেশ ছাড়েন পাক ক্রীড়াবিদ শাহিদা
স্থানীয় কর্মকর্তারা নিহতদের স্বজনদের জানিয়েছেন, মরদেহগুলো ইসলামিক রীতি অনুযায়ী দাফন করার জন্য দেশটির আরেকটি শহর বোলোগনায় পাঠানো হবে। কিন্তু স্বজনদের দাবি, মরদেহগুলো নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হোক। দাবি আদায়ে বিক্ষোভও করেছেন তারা।
ইটালির গণমাধ্যম আরএআই নিউজকে আলাদিন নামে এক আফগান তরুণ বলেন, “এই নৌকাডুবিতে আমার খালা ও তিন চাচাতো ভাইকে হারিয়েছি। এখন আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে চাই যে, মরদেহ কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে।”
এক আফগান নারী ইটালীয় বার্তা সংস্থা আনসাকে বলেছেন, “রোম মরদেহ নিয়ে খেলা করছে।”
আরো পড়ুন: ইটালিতে নৌকাডুবি: স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছেন নিহতের স্বজনরা
ইটালীয় সরকার বলছে, স্বজনদের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে চাইলেও মরদেহ নিয়ে আফগানিস্তানে ফ্লাইট পরিচালনা কঠিন। কারণ, ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান দেশটির ক্ষমতা দখলের পর থেকে ওই দেশে বিমান চলাচল স্থবির হয়ে পড়েছে।
এক বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বোলোগনায় দাফন করার সিদ্ধান্তটি ছিল একটি অন্তর্বর্তী সমাধান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে এতে বলা হয়, “আমরা প্রতিটি পরিবারের অনুরোধ রাখার চেষ্টা করব। যদি মরদেহ নিজ দেশে ফেরত দেয়ার কথা বলে, ইটালি সব খরচ বহন করবে।”
বার্তা সংস্থা আনসা নিশ্চিত করেছে, পারিবারিক সম্মতিতে ২৪টি মরদেহ দাফনে বোলোগনায় নেওয়া হবে। আর ১৭টি মরদেহ আফগানিস্তানে পাঠাতে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত ক্রোটোনে রাখা হবে।
টিএম/এমএইউ