সাম্প্রতিক মাসে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে অবৈধ অভিবাসনের বৃদ্ধির জন্য রুশ আধাসামরিক গোষ্ঠী ওয়াগনার দায়ী, এমনটাই অভিযোগ এনেছে ইটালীয় কর্তৃপক্ষ। লিবিয়ার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এমাদদ্দিন বাদির মতে, এটি একটি ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘অসমর্থিত’ বক্তব্য।
চলতি সপ্তাহের সোমবারে রোম কর্তৃপক্ষের একটি সংবাদবিজ্ঞপ্তি ইউরোপীয় অভিবাসন সংশ্লিষ্ট ও রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক তৈরি করেছে।
১৩ মার্চ সোমবার প্রকাশিত এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইটালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গিদো ক্রসেতো বলেন, “আমি মনে করি এটি এখন নিশ্চিত করে বলা সম্ভব যে আফ্রিকান উপকূল থেকে অভিবাসনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যা বৃদ্ধি রাশিয়ার হাইব্রিড যুদ্ধের একটি স্পষ্ট কৌশল। ‘ওয়াগনার’ এটি বাস্তবায়ন করছে।”
এই অভিযোগের কয়েক ঘণ্টা পর ইটালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি বার্তা সংস্থা আনসাকে বললেন, “
এটি ‘উদ্বেগজনক’ যে অনেক অভিবাসী ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে আসছেন।
ইটালীয় দৈনিক কোরিয়েরে দেলা সেরা আন্তোনিও তাজানির উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, “আমি চাই না অভিবাসীদের হাতিয়ার হিসেবে ইটালির দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হোক।”
আরও পড়ুন>>‘আমার পরিবারকে জানান যে আমি বেঁচে আছি’
রোমের মতে, “বছরের শুরু থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইটালীয় উপকূলে আগমনের বিস্ফোরক সংখ্যার পিছনে রুশ আধাসামরিক গোষ্ঠীটির সরাসরি প্রভাব রয়েছে।”

রোমের এই দাবিকে ‘হাস্যকর’ বলে ইনফোমাইগ্রেন্টসের কাছে মন্তব্য করেন লিবিয়ার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইম (জিআই-টোক)-এর গবেষক এমাদদ্দীন বদি।
‘বলির পাঁঠা’
ভূমধ্যসাগরের অন্য প্রান্তে ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতি এবং এর সদস্যরা ইউরোপের পাশাপাশি লিবিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বেশকিছু কৌশলগত হুমকি সৃষ্টি করলেও মানবপাচারের মাফিয়া চক্রের উপর গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণ প্রমাণিত নয়।
এমাদদ্দিন বদি বলেন, “ইটালির কর্মকর্তারা ওয়াগনারকে বলির পাঁঠা হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।”
আরও পড়ুন>>অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীদের জন্য অভিভাবক খুঁজছে ইটালি
লিবিয়ার উপকূল প্রকৃতপক্ষে ভূমধ্যসাগরের পারাপারের অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসার স্থান হিসেবে বহুল পরিচিত। অসংখ্য মাফিয়া গ্রুপ এই অঞ্চলের মানবপাচার বছরের পর বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে।
এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আরও বলেন,
অপরাধী নেটওয়ার্কগুলি অনেক বছর ধরে সেখানে সক্রিয়। অবশ্যই রাশিয়ার এই সমস্যা থেকে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তারা এটির জন্য দায়ী নয়।
তার মতে, “বাস্তবে ওয়াগনার গ্রুপের পক্ষে ইউরোপে অভিবাসন প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই। এটি ভিত্তিহীন ওয়াগনার সদস্যদের এই অবৈধ চক্র এবং মানবপাচারের বাজারে এখনোপর্যন্ত তেমন কোনো প্রভাব নেই। এই এলাকায় ওয়াগনার চাইলেও একচেটিয়া ক্ষমতা তৈরি করতে পারবে না। যা সমুদ্র পারাপারের গতিকে প্রভাবিত করতে পারবে।”
অপরদিকে ওয়াগনার গ্রুপের নেতা ইভজেনি প্রগোজিন ইটালির মন্ত্রী গিদো ক্রসেতোর অভিযোগের উত্তরে বলেন,
তার উচিত সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেয়া।সম্ভবত তিনি এসব সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম নন।
দৈনিক কোরিয়েরে দেলা সেরার এক প্রতিবেদনে ইভজেনি প্রগোজিনের বক্তব্য উল্লেখ করা বলা হয়, “আমরা জানি না অভিবাসন সংকটের সঙ্গে আর কী কী ঘটছে। আমরা এটি নিয়ন্ত্রণ করি না। আমাদের এমনিতেই অনেক সমস্যা রয়েছে, সেগুলোতে নজর দিচ্ছি।”
“পশ্চিমকে অস্থিতিশীল করা”
লিবিয়ায় আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। সেখানে ওয়াগনারের উপস্থিতি স্পষ্টত কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। গ্রুপটি উল্লেখযোগ্যভাবে লিবিয়ার মার্শাল হাফতারের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মার্শাল হাফতার ত্রিপোলি ভিত্তিক জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃপক্ষ। ফায়েজ সররাজ এটির নেতৃত্বে রয়েছে।
লিবিয়ার তেল, গ্যাস এবং সোনার মজুদের কারণে অনেক মিলিশিয়াদের জন্য এটি বেশ আকর্ষণীয় স্থান।
এমাদদ্দিন বদি বলেন, “ওয়াগনার এবং রাশিয়া সরকার যৌথভাবে লিবিয়ার ফেজানে [লিবিয়ার মরুভূমি অঞ্চল] অবৈধ সোনার খনির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। লিবিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটির কাছাকাছি এবং তেল স্থাপনার কাছাকাছি তারা নিজেদের অবস্থান জোরদার করেছে৷"

ওয়াগনার কোম্পানিকে বর্তমানে ক্রেমলিনের সশস্ত্র শাখা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে, এটি অনেক আফ্রিকান রাষ্ট্রের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে সাহেল, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং লিবিয়ার মতো জায়গায় যুদ্ধ পরিচালনা করছে।
ইটালির ‘অতিরঞ্জিত’ ও ‘আত্মঘাতী’ অভিযোগ
ইটালি কেন ওয়াগনারকে দোষারোপ করতে চায়? কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছে, লিবিয়ায় অভিবাসন ইস্যুতে ইটালি এবং ইউরোপীয় নেতারা ব্যর্থতার মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে রুশ-বিরোধী মনোভাব জাগানো অনেক সহজ বলে মনে করছেন।
২০১৭ সাল থেকে লিবিয়ার উপকূলরক্ষীকে সহায়তার জন্য রোম তিন কোটি ২৬ লাখ ইউরো প্রদান করেছে। কিন্তু সমুদ্র পারাপার থামানোর বাস্তব কোন সমাধান আসেনি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) অনুসারে, ২০২৩ সালের শুরু থেকে ২০ হাজারেও বেশি মানুষ ইটালীয় উপকূলে অবতরণ করেছে।
পড়ুন>>লিবিয়ায় অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার অভিবাসনপ্রত্যাশীরা
ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, “এই সংখ্যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি।”
পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে ইউরোপ অভিবাসন ইস্যুতে একটি সাধারণ নীতি অনুসরণ করার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র অভিবাসীদের অভ্যর্থনা এবং উদ্ধার নিয়ে নিজস্ব নিয়ম আরোপ করেছে।
বদি বলেন,
এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইটালীয় দৃষ্টিভঙ্গি আত্মঘাতী। কারণ একটি বাস্তব সমস্যার জন্য [ওয়াগনারকে] ভুলভাবে দায়ি করা হচ্ছে। যা প্রকৃত মানবপাচার নেটওয়ার্কগুলোকে কাজ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে। তাছাড়া, এই ভুল পরিস্থিতির কারণে সমস্যার প্রতিকারের জন্য সঠিক নীতিগুলোর ব্যবহার করা থেকে বাধা দেয়।
ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট মার্গারিটিস শিনাসও মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনের সময় একই বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, “ওয়াগনার অভিবাসন প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য দায়ী কি না সেটি মূল বিষয় নয়। আমাদের অবশ্যই মূল এবং ট্রানজিট দেশগুলিকে সাহায্য করতে হবে। কারণ অভিবাসনের মূল কারণ হল মানুষ একটি উন্নত জীবনের সন্ধানে, যুদ্ধ ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নিজের ঘর ছাড়ে।”
মূল প্রতিবেদন শার্লত বোয়াতিও। ইনফোমাইগ্রেন্টস বাংলায় ফরাসি থেকে ভাষান্তর মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ।
এমএইউ/আরকেসি