অভিবাসীদের একটি নৌকা ডুবে যাওয়ার তিন দিন পর জামাকাপড়, একটি লাইফ জ্যাকেট এবং কাঠের টুকরো সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসে৷ ছবি: আনসা/কারমেলো ইমবেসি
অভিবাসীদের একটি নৌকা ডুবে যাওয়ার তিন দিন পর জামাকাপড়, একটি লাইফ জ্যাকেট এবং কাঠের টুকরো সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসে৷ ছবি: আনসা/কারমেলো ইমবেসি

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ইটালির দক্ষিণ উপকূলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নৌকাডুবির ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৬। দুই শিশুসহ আরো পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত মৃত ৮৬ জনের মধ্যে ৩৫টি শিশু রয়েছে৷

ফেব্রুয়ারির শেষে দক্ষিণ ইটালির ক্যালাব্রিয়ার উপকূলে নৌকাডুবির দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে৷ তারপর ইটালি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা আরো পাঁচটি দেহ উদ্ধার করেছে। সাম্প্রতিককালে ইউরোপের সবচেয়ে মর্মান্তিক অভিবাসন বিপর্যয়গুলির মধ্যে এটি একটি।

বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বুধবার, (মার্চ ১৫) একজন আঞ্চলিক সরকারি কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন কর্তৃপক্ষ দুইটি শিশু (সাত বা আট বছর ছেলেশিশু বয়সি এবং তিন বছর বয়সি এক কন্যাশিশু), দুইজন পুরুষ এবং একজন নারীর মরদেহ উদ্ধার করেছে।

প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, কাঠের নৌযানটিতে ১৭০ জনেরও বেশি অভিবাসী ছিলেন৷ তুরস্কের ইজমির থেকে রওনা দিয়েছিলেন তারা৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি স্টেকাটো ডি কুত্রো শহরের কাছে ক্যালাব্রিয়ান উপকূলে সেটি ডুবে যায়৷

পালাসপোর্তে এলাকায় অভিবাসী জাহাজডুবির ঘটনায় মৃতদের সাদা কফিনের কাছে খেলনা রাখা হয়েছে৷ ৩৫টি শিশু প্রাণ হারিয়েছে এই দুর্ঘটনায়৷ ছবি: ইপিএ/কারমেলো ইম্বেসি
পালাসপোর্তে এলাকায় অভিবাসী জাহাজডুবির ঘটনায় মৃতদের সাদা কফিনের কাছে খেলনা রাখা হয়েছে৷ ৩৫টি শিশু প্রাণ হারিয়েছে এই দুর্ঘটনায়৷ ছবি: ইপিএ/কারমেলো ইম্বেসি

অনুসন্ধান অব্যাহত

ইটালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেদোসি পার্লামেন্টে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তিনি জানান, জাহাজডুবির ঘটনায় ৮০ জন মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ১৫ জন। তাদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে।

স্থানীয় মেয়র আন্তোনিও সেরাসো বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, "আশা করি নৌকায় থাকা কিছু লোক বেঁচে রয়েছেন৷ নৌকাডুবির পর ঘটনাস্থল থেকে তারা উধাও হয়ে যান৷’’

আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান ও সিরিয়ার নাগরিকরা নৌকায় ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভোররাতে সমুদ্রে প্রতিকূল পরিবেশ এবং অন্ধকার মিলিয়ে উদ্ধারকাজে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

ঘটনার পর থেকে, অনেক এনজিও প্রশ্ন তুলেছে ইটালি এবং ইইউ কর্তৃপক্ষ সত্যিই নৌকায় থাকা লোকদের বাঁচাতে যথেষ্ট কাজ করেছে কি?

মঙ্গলবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে ইইউ স্বরাষ্ট্র এবং অভিবাসন কমিশনার ইলভা ইওহানসন স্বীকার করেছেন, ফ্রন্টেক্সের একটি বিমান ক্যালাব্রিয়ার দিকে যাওয়ার সময় নৌকাটিকে দেখেছিল৷ জাহাজের ডেকে মাত্র একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফ্রন্টেক্স৷ জাহাজটির মধ্যে দুর্দশার কোনো চিহ্ন ছিল না৷ জাহাজে যে ১৭৯-এর কাছাকাছি যাত্রী ছিল বলে জানানো হচ্ছে এখন, সেইসময় তার চিহ্নমাত্র ছিল না৷

রয়টার্স জানিয়েছে, জাহাজটি ডুবে যাওয়ার আগে তাদের উদ্ধার করতে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল পুলিশ ৷ তবে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

নৌকার ডেকের বোর্ডে কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন যা অবশেষে ডুবে যায় ফ্রন্টেক্সের ছবিতে এমনই ধরা পড়েছে| সূত্র: ফ্রন্টেক্স
নৌকার ডেকের বোর্ডে কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন যা অবশেষে ডুবে যায় ফ্রন্টেক্সের ছবিতে এমনই ধরা পড়েছে| সূত্র: ফ্রন্টেক্স

'ট্র্যাজেডি'-র পর ফ্রন্টেক্সের বিবৃতি

১ মার্চ ইউরোপীয় বর্ডার এজেন্সি ফ্রন্টেক্স এক বিবৃতিতে এ ঘটনাকে "ক্রোটোন ট্র্যাজেডি" বলে উল্লেখ করেছে। 

বিবৃতিতে বলা হয়, ফ্রন্টেক্সের একটি বিমান দেখতে পায়, ইটালির উপকূলে একটি নৌকা ভেসে যাচ্ছে। কমিশনার ইওহানসন যেমন বলেছেন, একই বিবৃতি দিয়ে তারাও জানিয়েছে, জাহাজের ডেকে কেবল একজনকেই তারা দেখতে পেয়েছিল৷ জাহাজটিতে কোনোরকম দুর্দশার চিহ্ন ছিল না৷

ফ্রন্টেক্সের বিমানে থার্মাল ক্যামেরা আছে৷ জাহাজের ডেকের নীচে লোক থাকতে পারে এমন অন্যান্য লক্ষণ তার মাধ্যমে পরবর্তীতে ধরা পড়েছে। ফ্রন্টেক্স বলেছে, এর ফলে নজরদারি বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ বাড়ে৷

ফ্রন্টেক্সের দাবি, ‘‘আমরা অবিলম্বে থেমিস অপারেশনের আন্তর্জাতিক সমন্বয় কেন্দ্রকে [ইটালীয়-ফ্রন্টেক্স যৌথ অভিযান, যা ইটালির দিক থেকে অনুসন্ধান ও উদ্ধারের পাশাপাশি টহল কাজ করে] এবং অন্যান্য ইটালীয় কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে জানাই৷ সেটির অবস্থান, ইনফ্রারেড ছবি, নৌযানের গতিও জানানো হয়৷’’

বাংলাদেশের সিফুল ১২ মার্চ লিবিয়ার উপকূলে একটি জাহাজডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১৭ জনের একজন। ছবি:আনসা
বাংলাদেশের সিফুল ১২ মার্চ লিবিয়ার উপকূলে একটি জাহাজডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ১৭ জনের একজন। ছবি:আনসা

ফ্রন্টেক্স বলেছে, তাদের বিমান "জ্বালানি স্বল্পতার কারণে" ঘাঁটিতে ফিরে না আসা পর্যন্ত জলযানটিকে পর্যবেক্ষণ করে। ইটালি কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই "জাহাজটিকে আটকাতে দুটি টহল নৌকা পাঠায়৷ তবে, প্রতিকূল আবহাওয়ায় সেগুলো বন্দরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়৷"

ফ্রন্টেক্স জানিয়েছে, রোববার ভোরে ইটালির উপকূলে জাহাজটি ডুবে যাওয়ার পরই অভিযান ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। উদ্ধার ও অনুসন্ধান অভিযান ইটালির কর্তৃপক্ষই পরিচালনা করছিল৷

জর্জা মেলোনি: 'বিবেকের কাছে আমি স্বচ্ছ'

ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি, ব্রাদার্স অফ ইতালি পার্টির নেত্রী৷ এই দল বারবার অনিয়মিত অভিবাসনের বিরোধিতা করেছে৷ তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘‘সরকার এবং আমার বিরুদ্ধে নৃশংসতার এই অভিযোগ আনা হয়েছে৷ তবে বিবেকের কাছে আমরা স্বচ্ছ৷’’

ইটালির সমালোচনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সরকার এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে৷ আরেকটি জাহাজডুবির ঘটনায় গত সপ্তাহান্তে আরো ৩০ জন প্রাণ হারিয়েছেন৷ 

ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি৷ ছবি: আনসা/ফিলিপ্পো আত্তিলি৷
ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনি৷ ছবি: আনসা/ফিলিপ্পো আত্তিলি৷

এইচআরডব্লিউ-এর ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ার গবেষক জলিয়া ট্র্যাঞ্চিনা বলেছেন, মানবিক সংস্থা অ্যালার্ম ফোন ১১ মার্চ কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিল যে আন্তর্জাতিক জলসীমায় একটি নৌযানে ৪৭ জন যাত্রী রয়েছে৷ তবে কর্তৃপক্ষ তা গুরুত্ব দেয়নি৷ অ্যালার্ম ফোন সাধারণত ইউরোপ অভিমুখে অভিবাসী যাত্রার উপর নজরদারি করে৷ 

জাহাজটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল৷ তবে যে সামুদ্রিক এলাকায় ছিল সেটি লিবিয়ান এসএআর জোন হিসাবে চিহ্নিত। তার মানে, লিবিয়ার কর্তৃপক্ষ নৌকা উদ্ধারকাজের দায়িত্বে ছিল। কিন্তু যদি তারা এ কাজ না করলে তবে নিকটতম উপকূলীয় রাজ্যগুলো, এই ক্ষেত্রে লিবিয়া নইলে মাল্টারও বিষয়টি দেখার দায়িত্ব রয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ: ইটালি এবং ইইউ শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে

এইচআরডাব্লিউ ইটালি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ২৭ ঘণ্টা হাত গুটিয়ে বসে থাকার অভিযোগ এনেছে৷ আরো বলা হয়েছে, দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা জাহাজগুলোকে বিষয়টিতে ‘নাক না গলাতে’ এবং লিবিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ না করার নির্দেশ দিয়েছিল ইটালি। 

লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা জানায়, তাদের কাছে উদ্ধারকাজে পাঠানোর জন্য কোনো নৌযান ছিল না৷ যদিও ট্র্যাঞ্চিনা উল্লেখ করেছেন, সমুদ্রে জীবন বাঁচাতে সাহায্য করার জন্য ইটালি এবং ইইউ থেকে টহল নৌকা এবং কয়েক মিলিয়ন ইউরো সাহায্য পেয়েছে লিবিয়া কর্তৃপক্ষ।

এইচআরডব্লিউ রিপোর্টে, ট্র্যাঞ্চিনা এটিকে "ইটালি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে কর্তব্যের ইচ্ছাকৃত লঙ্ঘন” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফলে সবশেষ ট্র্যাজেডিটি ঘটে বলেও জানিয়েছে তারা।

রিপোর্টে তিনি জানিয়েছেন, মানবিক উদ্ধার জাহাজগুলোকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে তাদের কাজে বাধা দেওয়া হয়৷ অভিবাসী ও শরণার্থীদের আটকাতে এবং জোর করে ফেরত পাঠাতে লিবিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যাপক সহযোগিতা করেছে ইটালি৷

এই অভিযোগ সত্ত্বেও, ইইউ সাংবাদিক সম্মেলনে কমিশনার ইওহানসন বেশ কয়েকবার বলেন, ইটালি কর্তৃপক্ষ জীবন বাঁচাতে খুব ভাল কাজ করছে৷ শুধুমাত্র গত সপ্তাহান্তেই এক হাজার ৩০০ জন অভিবাসীকে উদ্ধারের পর নিরাপদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ইটালির উপকূলরক্ষী এবং গার্দিয়া ডি ফিনাঞ্জা (শুল্ক ও সীমান্ত পুলিশ) এ কাজে সহায়তা করেছে।

১৫ মার্চ ইটালির প্রধানমন্ত্রী মেলোনি গত সপ্তাহান্তে জাহাজডুবির ঘটনা নিয়ে একাধিক প্রশ্নের মুখে পড়েছেন৷ মেলোনি বলেন, এই অভিযান প্রথমে লিবিয়া কর্তৃপক্ষ সমন্বয় করছিল। লিবিয়ার তরফে ইটালির কাছে অনুরোধ আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা বিষয়টি পরিচালনা করেন৷

স্বজনদের সঙ্গে দেখা

ইটালির উপকূলরক্ষী কমান্ডারের কাছ থেকে ব্যাখ্যাটি পড়ে শোনান মেলোনি ৷ তিনি উল্লেখ করেছিলেন, লিবিয়া উদ্ধারকাজে সমন্বয় করতে অস্বীকার করলে, দায়িত্বটি পরবর্তী ক্ষেত্রে মাল্টার কাছে যাওয়া উচিত ছিল৷ মাল্টা পরবর্তী নিকটতম রাষ্ট্র। উপকূলরক্ষী বাহিনী বলেছে, ইটালির যে দুটি জাহাজ প্রস্তুত ছিল, সেগুলো অনেক দূরে ছিল৷ অন্যটি সেখানে গিয়ে নিরাপদে অবতরণ করতে পারেনি অথবা আয়োনিয়ান সাগরে অন্য অভিবাসীদের উদ্ধারে ব্যস্ত ছিল।

মেলোনির দাবি, পরবর্তী নিকটতম ইটালির সামরিক জাহাজটি ২২০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল৷ এই কারণেই দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা বাণিজ্যিক জাহাজকে সাহায্যের কথা বলা হয়৷ এই জাহাজগুলি উদ্ধার অভিযানে অসংখ্যবার ব্যবহার করা হয়েছে৷ এক লাখের বেশি জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে৷ তাই সরকার এখন বিবেকের কাছে পরিষ্কার৷’’

মেলোনি ক্যালাব্রিয়ার উপকূলে মৃত ৩০ জন ব্যক্তির আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন৷ আনুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মৃতের স্বজনদের৷ 

ইটালির অনলাইন সংবাদমাধ্যম ফ্যানপেজ ডট আইটি জানিয়েছে, মেলোনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ডুবে যাওয়া নৌযানে থাকা অভিবাসীদের খোঁজ চলবে।

মেলোনি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন, তার সরকার মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে যাতে সমুদ্রে অনিয়মিত অভিবাসীদের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া বন্ধ হয়।

এমা ওয়ালিস/আরকেসি

 

অন্যান্য প্রতিবেদন