তুরস্কের শহর ইস্তাম্বুলের একটি রেস্তোরাঁ ইয়োলো ক্যাফে৷ যা রেস্তোরাঁ পরিচয় ছাপিয়ে পরিণত হয়েছে ওই দেশে আশ্রয় নেওয়া সিরীয় অভিবাসীদের সংস্কৃতি কেন্দ্রে৷
ভালোবাসার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাফেটি গড়ে তুলেছেন বায়ান৷ ৩৪ বছরের এই নারীর জন্ম সিরিয়ায়৷ গৃহযুদ্ধের তাণ্ডব থেকে বাঁচতে নিজ শহর আলেপ্পো ছেড়ে বছর দশেক আগে তুরস্কে পাড়ি জমান তিনি৷
সিরিয়ায় স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করেছিলেন বায়ান৷ কিন্তু যুদ্ধ পালিয়ে আসা তরুণীর শিক্ষার স্বীকৃতি দেয়নি তুরস্ক৷ তাই বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করে জীবিকার সংস্থান করেছিলেন তিনি৷
মাস সাতেক হলো প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে চালু করেছেন ইয়োলো ক্যাফে৷ আর তুরস্কে থাকা সিরিয়ানদের জন্য এটি এখন সংস্কৃতি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে৷ সিরীয় শরণার্থীদের জন্য এখানে রয়েছে আরবি শেখার সুযোগ৷
বায়ান বলেন, ‘‘তুরস্কে সিরিয়ান হওয়া সহজ কাজ নয়৷ তাই ইস্তাম্বুলে যে কয়েকটি স্থানে আরবি ভাষায় শিল্প, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা হয়, তার মধ্যে আমাদের রেস্তোরাঁও একটি৷’’
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর হলে দেশটির অন্তত ৪০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক৷ তাদের মধ্যে অন্তত পাঁচ লাখ সিরীয় বসবাস করছেন ইস্তাম্বুলে৷
বায়ান বলেন, ‘‘ফলে, সিরীয়দের নিয়ে আলাপ আলোচনার জন্য একটি বিশেষ স্থানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম৷ আর সেটাই আমাদের এই ক্যাফেটি গড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে৷’’

নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা
নিজের ক্যাফের এক কোনায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন বায়ান৷ তখন মৃদু স্বরে বাজছিল একটি আরবি গান৷
তিনি বলেন, ‘‘সিরীয়দের চাঙ্গা রাখতে চাই আমরা৷ এখানে আসার অর্থ হলো, নিজের প্রতিদিনের রুটিনকে ভেঙে ফেলা৷ কারণ আমরা দেখি, একজন সিরীয় শরণার্থী প্রতিদিন বাসা থেকে কাজে যাচ্ছেন৷ কাজ শেষে বাসায় ফিরছেন৷ কিন্তু এর বাইরে আর কোনো জীবন নেই তার৷’’
মধ্যপ্রাচ্যের খাবারের স্বাদ নিতে সিরীয় শরণার্থীদের পরিচালিত একটি খাবারের দোকানে অবশ্য তাদের যাওয়া আসা আছে৷ ইয়োলোর ক্রেতাদের বেশিরভাগের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে৷ তারা শুধু সিরিয়ান নয়৷ অনেক আমেরিকান এবং ইউরোপীয়রাও আসেন এই রেস্তোরাঁয়, ইস্তাম্বুলের স্থানীয়দের কমবেশি আসা-যাওয়া আছে৷
থরে থরে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রেখে ক্রেতাদের চা-কফি পরিবেশন করা এই ক্যাফের মূল উদ্দেশ্য নয় বলে জানান বায়ান৷৷ তিনি জানালেন, এখানে লোকজ গান, কারাওকে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আলোচনা এবং আরবি ভাষায় স্ট্যান্ড-আপ কমেডিসহ কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়।

প্রতিবেশীদের চক্ষুশূল ইয়োলো
সাত মাসে রেস্তোরাঁটি যা অর্জন করেছে তা নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট এটির প্রতিষ্ঠাতা বায়ান৷ তবে দুশ্চিন্তাও আছে কিছু৷ কারণ প্রতিবেশীদের কাছ থেকে মিলছে না সহযোগিতা৷ আছে চাপা উত্তেজনা৷
বায়ান বলেন, ‘‘ঝামেলা হলো, প্রতিবেশী তুর্কিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এতটা ভালো নয়৷ রেস্তোরাঁ চালু করার বিষয়টি, তারা সহজভাবে নেয়নি৷ পরিস্থিতি এখনো জটিল রয়ে গিয়েছে৷’’
গৃহযুদ্ধের পর লাখো সিরীয়কে আশ্রয় দিয়ে প্রশংসিত হয়েছে তুরস্ক৷ কিন্তু সম্প্রতি দেশটিতে বেড়েছে অভিবাসী ও শরণার্থী বিরোধী মনোভাব৷ ২০১০ সাল থেকে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক৷ দেশটির অনেক নাগরিকেরা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ আর এসব কারণে, অভিবাসী ও শরণার্থীদের প্রতি তাদের ক্ষোভ বাড়ছে৷ তুরস্কের অনেকেই মনে করেন শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ধীর হচ্ছে এবং চাকরির বাজারেও নিজেদের বঞ্চিত ভাবছেন তারা৷ দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতিও বেড়েছে৷
বায়ান বলেছেন, গত কয়েক বছর ধরে সিরীয় শরণার্থীদের পরিচালিত অনেক রেস্টুরেন্ট দোকানাপাটে হামলা করেছেন স্থানীয়রা৷ তাদের আক্রমণ থেকে ইয়োলোও বাদ পড়েনি বলেও জানান তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কথা বলা শুধু নয়, গত তিন মাসে অন্তত তিনবার এই ক্যাফেতে আক্রমণ করেছেন স্থানীয়রা৷ কোনো কারণ ছাড়াই কিছু মানুষকে তারা শারীরিকভাবে নিগ্রহ করেছেন, এমনকি ছুরি দেখিয়ে শ্বাসিয়েও গেছেন৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ক্যাফেতে থাকা কয়েকজন লোক বাইরে সিগারেট খেতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন৷ তখন আরবি কথা শুনেই তাদের ওপর আক্রমণ চালান তুরস্কের নাগরিকেরা৷’’
ওই ঘটনায় বিরক্ত হয়ে ক্যাফের প্রতিবেশীরা পুলিশে খবর দিয়েছিলেন বলেও জানান বায়ান৷ তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ আসার পর তারা দাবি করেন, এই আক্রমণ এবং পুলিশে খবর দেয়ার মূল কারণ আসলে আমরা সিরীয় নাগরিক৷’’

ইয়োলো সবার বৈঠকখানা
ইয়োলোকে সবার জন্য একটি আড্ডাখানায় রূপ দিতে চান এটির উদ্যোক্তরা৷ প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত সিরিয়ান-মরোক্কান প্রকৌশলী মাজদ বলেন, ‘‘ইয়োলো হবে সবার৷ এখানে জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত, লৈঙ্গিক কোনো পরিচয় থাকবে না৷’’
আক্ষেপের সুরে এই তরুণ বলেন, ‘‘রাস্তায় হাঁটার সময় নিজেদর পরিচয় আমরা লুকিয়ে রাখি৷ যদি কেউ বুঝতে পারে আপনি সিরীয়, তাহলে আপনার জন্য নরকযন্ত্রণা অপেক্ষা করছে৷’’
টিএম/আরকেসি (আনসা)