ভূমধ্যসাগরে ইটালিমুখী অভিবাসীবাহী একটি নৌকাকে আটকে দিচ্ছে টিউনিশিয়ার উপকূলরক্ষীরা৷ ফাইল ছবি: রয়টার্স/জিহেদ আবিদেলাউয়ি
ভূমধ্যসাগরে ইটালিমুখী অভিবাসীবাহী একটি নৌকাকে আটকে দিচ্ছে টিউনিশিয়ার উপকূলরক্ষীরা৷ ফাইল ছবি: রয়টার্স/জিহেদ আবিদেলাউয়ি

সংঘাত বা সংঘর্ষ নয়, দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নে এ বছর রেকর্ড সংখ্যক অনিয়মিত অভিবাসীর আগমন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জোটের সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স৷ শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি৷

মানবপাচারকারী চক্রগুলো সহজেই নৌকা তৈরি করতে পারার কারণে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপমুখী অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলে মনে করেন ফ্রন্টেক্স প্রধান হানস লেইটেনস৷

এ বছরের প্রথম চার মাসে মধ্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ৪২ হাজার ২০০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আগমন রেকর্ড করেছে সংস্থাটি৷ একই সময়ে গত বছরের সংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা তিনশ গুণ বেশি৷ এ প্রসঙ্গে হানস লেইটেনস বলেন, ‘‘আমি এমন পরিস্থিতি আগে কখনও দেখিনি৷’’

বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফ্রন্টেক্স প্রধান জানান, চলতি বছর এ পর্যন্ত বিভিন্ন রুট হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অন্তত ৮০ হাজার ৭০০ অভিবাসী অনিয়মিত পথে প্রবেশ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে টিউনিশিয়া থেকে অভিবাসী আগমনের হার গত বছরের তুলনায় এক হাজার ১০০ ভাগ বেড়েছে৷’’

আরো পড়ুন>>ইটালি-ফ্রান্স সীমান্তে নজরদারি করবে ড্রোন

এক বিবৃতিতে ফ্রন্টেক্স জানিয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করা দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসীর হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে৷

হানস লেইটেনসের মতে, অভিবাসীদের আগমণ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মানবপাচারকারীদের কর্মপদ্ধতি পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে৷ এছাড়া, পারাপারে খরচ কমে আসাকেও একটি কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি৷

লেইটেনস বলেন, ‘‘তারা (মানবপাচারকারী) এখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সমুদ্রের পাড়ে ধাতব নৌকা তৈরি করতে পারেন৷ এর জন্য খরচ হয় মাত্র এক হাজার ইউরো (এক লাখ টাকার কিছু বেশি)৷’’

মানবপাচারকারীরা আগের তুলনায় আরো সংগঠিত হয়ে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে বলেও মনে করেন ফ্রন্টেক্স প্রধান৷ এমনকি, তাদের প্রতিযোগিতার কারণে অন্তত একটি নৌকা ডুবে গেছে বলেও জানান তিনি৷ তবে নৌকাটি কবে, কোথায় ডুবেছে, তা তিনি জানাননি।

আরো পড়ুন>>রোমানিয়া থেকে চার মাসে ৭৯ বাংলাদেশিসহ প্রায় ৩০০ জনকে জোরপূর্বক ফেরত

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স প্রধান হানস লেইটেনস৷ ছবি: ভার্জিনিয়া মায়ো/এপি/পিকচার অ্যালায়েন্স
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স প্রধান হানস লেইটেনস৷ ছবি: ভার্জিনিয়া মায়ো/এপি/পিকচার অ্যালায়েন্স

হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অন্য অধিকার সংস্থাগুলো অবশ্য ভিন্ন কথা বলছে৷ তাদের অভিযোগ, লিবিয়ার উপকূলরক্ষীদের সহযোগিতায় অভিবাসীবাহী নৌকাগুলো আটকে দিতে দেশটিতে জড়ো হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নির্যাতনে মদদ দিচ্ছে ফ্রন্টেক্স৷ 

এমন অভিযোগ অস্বীকার করে লেইটেনস বলেছেন, ফ্রন্টেক্স এ বিষয়ে লিবিয়াকে কোনো ধরনের সহযোগিতাই করেনি৷ ইউরোপীয় অনুসন্ধান এবং উদ্ধার এলাকায় আসা অভিবাসীবাহী নৌকার অবস্থান জানিয়ে তাদের পুশব্যাক (জোর করে ফেরত পাঠানো) করতেও লিবিয়ার উপকূলরক্ষীদের কোনো সহায়তা করেনি বলেও দাবি করেন সংস্থাটির প্রধান৷

আরো পড়ুন>>২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুত সাত কোটি মানুষ

তিনি বলেন, ‘‘আমরা যা করি, সেটা হলো, ভূমধ্যসাগরে একটি অভিবাসীবাহী নৌকা যখন বিপদসঙ্কুল অবস্থায় পড়ে তখন আমরা মে ডে কল দিই, সেই কলটি লিবিয়া ও টিউনিশিয়া কর্তৃপক্ষও গ্রহণ করে৷’’

লেইটেনস বলেন, ‘‘সমন্বয় কেন্দ্র যদি মনে করে, এই উদ্ধার অভিযানটি লিবিয়া পরিচালনা করবে, তখন তারা উদ্ধারে এগিয়ে আসবে এবং মানুষের জীবন বাঁচাবে৷ কিন্তু পুশব্যাক সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘শুনতে কর্কশ মনে হলেও সত্য হলো, (মে ডে কল দেয়ার পর) অভিবাসীদের কারা উদ্ধার করছে সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই৷’’

জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন সতর্ক করে জানিয়েছে, ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টার সময় লিবিয়ায় আটকে পড়া অভিবাসীদের পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন এবং যৌন দাসত্বে বাধ্য করা হচ্ছে।

আরো পড়ুন>>অভিবাসন নিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ইউরোপীয়রা

সংস্থাটির সাবেক প্রধান ফ্যাব্রিস লেজ্জেরি জানুয়ারিতে পদত্যাগের পর, মার্চে ফ্রন্টেক্স-এর দায়িত্ব নেন লেইটেনস৷ দায়িত্ব নেয়ার পর, সংস্থার প্রতি আস্থা ফেরানো এবং ইউরোপী ইউনিয়নের সীমান্তে অভিবাসীদের পুশব্যাক বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত সংস্থাটি পুনর্গঠনেরও আশ্বাস ছিল তার কণ্ঠে৷

কিন্তু, দায়িত্ব নেয়ার দুই মাস পরেও ইইউ সীমান্তে যে নিয়ম বর্হিভূত পুশব্যাক হচ্ছে না সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি লেইটেনস৷

তিনি বলেন, ‘‘যখন আমরা জানতে পারি যে এমন ঘটনা (পুশব্যাক) ঘটতে পারে, আমরা তা ঠেকাতে সেখানে থাকার চেষ্টা করি৷ আমরা আমাদের জনগণকে এ বিষয়গুলো শেখানোর চেষ্টা করছি৷’’

ফ্রন্টেক্স-এর কাজ নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন তুলে আসা বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি৷ পুশব্যাকের অনুমতি দেয়ার জন্য অভিযুক্ত ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনার সময়েও তা ঠেকাতে নিজের অবস্থান থেকে কথা বলেন বলেও দাবি করেন লেইটেনস৷

আরো পড়ুন>>সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ নয়, অনিয়মিতদের প্রত্যাবাসনে উদ্যোগ চান চেক প্রধানমন্ত্রী

ইইউ সীমান্ত অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের ভূমিকা সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয় ফ্রন্টেক্স প্রধানের কাছে৷ জবাবে তিনি বলেন, ‘‘নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, এটি তাদের প্লেবুকে আছে৷ তবে এটি তারা ব্যবহার করবে কিনা, তা তাদের ওপর নির্ভর করে৷ কিন্তু তাদের এটি করার ক্ষমতা রয়েছে৷’’

লেইটেনস বলেন, ‘‘আমি পুটিন বা অন্যদের মাথায় কী চলছে তা জানি না৷ তবে এটি তাদের প্লেবুকে রয়েছে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত৷’’

টিএম/এডিকে (এএফপি, রয়টার্স)

 

অন্যান্য প্রতিবেদন