বছয় দুয়েক আগের কথা৷ কেদার বয়স তখন ১৪৷ দারিদ্রপীড়িত পরিবারের মুখে হাসি ফেরাতে ঘর ছাড়েন এই কিশোর অভিবাসী৷ ভেবেছিলেন নাইজেরিয়া ছেড়ে ইউরোপ পৌঁছালে, দূর হবে দারিদ্র্য৷ তারপর দুই বছরের দীর্ঘ যাত্রা৷
অবশেষে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউরোপে পৌঁছালেন তিনি৷ ইটালির রোমের কাছের একটি বন্দর থেকে ২৮জন কিশোরকে উদ্ধার করা হয়৷ তাদের মধ্যে কেদাও একজন৷ যার বয়স এখন ১৬৷ আর সবার মতো তারও ঠাঁই হবে এখানকার একটি আশ্রয়শিবিরে৷
ইটালির সামাজিক পরিষেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত মধ্যস্থতাকারী মাগদা হাসেন বার্তা সংস্থা আনসাকে বলেন, ‘‘তিনি এখন ১৬ বছরের কিশোর, কিন্তু তার মধ্যে বাচ্চাসুলভ চেহেরা আছে৷’’
তিনি বলেন, “মাঝে মাঝে তাকে শিশুর মতো ভয়ার্ত দেখায়৷ আবার কখনও তার চোখের রঙ বদলে যায়৷ মনে হয় সে ভীষণ দৃঢ়চেতা৷”
লিবিয়ায় দাসত্বের জীবন
সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় কেদা৷ তাই কিশোর বয়স থেকেই দায়িত্বের বোঝা নিতে হয়েছে তার কাঁধে৷ এ কারণে কিছু অর্থকড়ি সঙ্গে নিয়ে ভাগ্য বদলের আশায় নিজ দেশ নাইজেরিয়া ছেড়ে আসেন তিনি৷
কেদার বাবা ছিলেন কৃষক৷ জমিতে যা উৎপাদন হতো সেগুলো নিয়ে রাস্তার ধারে বসে বিক্রি করতেন তার মা৷ আয় যা, তা দিয়ে সংসার চলে না৷
মাগদা হাসেন বলেন, ‘‘কেদা বারবার বলতে থাকেন, তার পরিবারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা আছে৷ তাই ভালো জীবনের আশায় পরিবারের কিছু সঞ্চয় নিয়ে ইটালির পথে যাত্রা করেছিলেন৷’’
ইটালির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে লিবিয়াতে কেটেছে তার জীবনের একটি বছর৷ হাসেন তার সঙ্গে কথা বলে জানান, ‘‘জীবনের যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার কথা কিশোরটি আমাদের শুনিয়েছেন৷ বলছিলেন, লিবিয়ায় একদিন বুঝতে পারলেন তার দাসত্বের জীবন শুরু হয়েছে৷’’
লিবিয়ায় এক বছরের একটু বেশি সময় ছিলেন কেডা৷ ভেবেছিলেন, হয়তো ইটালি পৌঁছানোর আগে কিছুদিন সেখানে থাকতে হবে৷ কদিন যেতেই তিনি বুঝতে পারলেন, পরিবার তাকে যে অর্থ দিয়েছে সেটা দিয়ে ইটালি পৌঁছানো সম্ভব নয়৷
যে ব্যক্তির হাত ধরে তার ইটালি যাওয়ার কথা ছিল, সেই লোকটিই তাকে জানালেন, অর্থ আয় করতে হলে তাদের জন্য কাজ করতে হবে৷ তাই গাড়ি ধোয়া এবং গ্যাস স্টেশনে কাজ করেছেন কেদা৷ কিন্তু বিনিময়ে কোনো অর্থ দেয়া হতো না তাকে৷
কেদা যখন তার পারিশ্রমিক আর ইটালি যাওয়ার কথা জানতে চাইতেন, তখন তাকে বলা হলো, যেদিন টাকা পাওয়ার যোগ্য হবে, সেদিন তাকে জানানো হবে, ইটালিও নিয়ে যাওয়া হবে৷ এভাবেই কিছু না জেনে-বুঝে, বিনা পারিশ্রমিকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে গেছেন কেদা৷
হুট করে একদিন তাকে বলা হলো, এবার তোমার পালা৷ এরপর তাকে অন্য অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে করে একটি হাবে নিয়ে যাওয়া হয়৷ যেখানে কয়েক সপ্তাহ ধরে রাখা হয়৷
রাবারের ডিঙ্গিতে ভাসা
কেদাসহ অন্যদের যখন ইটালির পাঠাতে সমুদ্রপাড়ে নেয়া হয়, তখন সেখানে কোনো নৌযান ছিল না৷ এটা দেখে খুব হতাশ হয়েছিল কেদা৷ মনে হচ্ছিল, ইটালি বোধয় আর যাওয়া হবে না৷
খানিক বাদে পাচারকারী চক্রটি রাবারের ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে আসে৷ কিন্তু তখনও সেটি ছিল প্যাকেটবন্দি৷ পরে আরোহীদের সামনেই সেই নৌকাটি ফুলানো হয়৷ শুরু হয় যাত্রা৷ সঙ্গীদের সঙ্গে সেই নৌকায় পাঁচ ঘণ্টা ছিলেন কেদা৷ কিন্তু তার মনে হয়েছে সময়টা আরো দীর্ঘ হতে পারে৷
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তাদের উদ্ধার করা হয়৷ মাগদা হাসেন বলেন, ‘‘যখন তাদের উদ্ধার করি তখন তাদের সবার শরীর ভেজা ছিল৷ ওটা ছিল একটা ভয়ঙ্কর মুহূর্ত৷’’
কেদা অবশ্য তখন এসব নিয়ে ভাবছিলেন না৷ তার ভাবনা একটাই, কিভাবে অর্থ আয় করা যাবে, আর সেই অর্থ পরিবারের কাছে পাঠাতে হবে৷ কেদা বলেন, ‘‘যে চাকরি পাবো, সেটিই করতে চাই আমি৷’’
কিন্তু নাইজেরিয়ান এই কিশোরের এখনই চাকরি করার সুযোগ নেই৷ কারণ তাকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে৷ তবে তা সময় ক্ষেপণ করলেও কেদার নিজের এবং পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে৷
টিএম/এমএইউ